জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান:
হজ—মানবতার উচ্চতম আত্মসমর্পণ, হৃদয়ের নিঃশব্দ ক্রন্দন, ত্যাগের নিগূঢ় প্রতীক। পবিত্র কাবা ঘিরে লক্ষ লক্ষ সাদা ইহরামে মোড়ানো প্রাণের ঘূর্ণন যেন একটি অনন্ত সৌন্দর্যপূর্ব ঈশ্বরতত্ত্বের প্রকাশ। এ এক বিশ্বজনীন আহ্বান—“লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক”।
তবু এই আলোকময় দৃশ্যপটের অন্তরালে আজ রচিত হচ্ছে এক নীরব, নির্মম অর্থনৈতিক অন্ধকার। যেখানে আত্মশুদ্ধির নামে গমন করা যাত্রার পেছনে আছে এমন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা, যা ভেদ করে দিচ্ছে মুসলিম চেতনাকে। হজ এখন আর নিছক ধর্মীয় ইবাদত নয়, বরং এক নিষ্ক্রিয় আর্থিক সহযোগিতার উপনিবেশ—যা পরোক্ষভাবে লালন করছে বিশ্ব রাজনীতির বেনিয়ামি সমরনীতি।
প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে হজে যান প্রায় দেড় লাখ মানুষ। গড় ব্যয় প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। বছরে এই খাতে দেশ থেকে গমন করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, যার সিংহভাগ যায় সৌদি আরবে। সৌদি আরব হজ, উমরাহ ও ধর্মীয় পর্যটন থেকে আয় করে বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার, যা তাদের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু সেই অর্থের ব্যবহারে স্পষ্ট এক বিপরীত ধর্মীয় চিত্র। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক চুক্তি ছিল ইতিহাসের সর্ববৃহৎ অস্ত্রবাণিজ্য। এই অর্থের উৎসের বড় অংশই আসে হজ ও উমরাহ থেকে অর্জিত আয় থেকে। সেই অর্থে কেনা হয় যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র, বোমা—যেগুলো গাজা, ইয়েমেন, সিরিয়া ও লেবাননের আকাশে ছিটিয়ে দেয় মৃত্যুর রেণু।
হজের ডলারে গড়ে ওঠে রণতরী, ঝরে পড়ে রক্ত, পুড়ে যায় ঘর, আর ধ্বংস হয় শহর। আর আমরা? আমরা পরম তৃপ্তিতে ঘোষণা করি—“হজ করে এলাম”।
আত্মশুদ্ধির তৃষ্ণা মিটিয়ে ফেরার পথে আমরা জানিও না, এই সফরের অর্থ কোথায় গিয়েছে, কাদের হাতে পড়েছে, কী নির্মাণ করেছে।
আত্মশুদ্ধির ইবাদত যদি পরিণত হয় পরোক্ষ গণবিধ্বংসী অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষকতায়, তবে তা আর নিছক ইবাদত থাকে না—তা হয়ে ওঠে এক ভয়াবহ আত্মপ্রবঞ্চনা।
ইসলামে হজ ফরজ, তবে কেবল সেই ব্যক্তির জন্য—যার “সামর্থ্য” রয়েছে (সূরা আল-ইমরান ৯৭)।
অথচ সমাজে দেখা যায়, কেউ পাঁচবার, কেউ দশবার হজ করছেন। একদিকে হাজার হাজার ডলার খরচ, অন্যদিকে পাশের ঘরে অনাহারে দিন কাটানো মানুষ, মাদরাসায় ফি না দিতে পারা শিশু, কিংবা গাজায় আমেরিকার অর্থে ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতবিক্ষত এক শহর। এই বৈপরীত্য ধর্মের নামে এক নিঃশব্দ দুর্বিনীততা।
আজকের পৃথিবীতে হজ শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক ভ্রমণ নয়, এটি একটি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থান। আপনি কোথায় দাঁড়াবেন, কার অর্থনীতিকে মজবুত করবেন, কোন রাষ্ট্রের কোষাগারে অর্থ দিবেন—সেসবও আজ ঈমানদারির অংশ। কেননা ইসলাম কেবল নামাজ-রোজার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, যার অন্তর্গত আছে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা, অর্থনৈতিক সত্ত্বা ও নৈতিক অবস্থান।
ফিলিস্তিনে যখন শিশুর লাশ সারি সারি পড়ে থাকে, তখন সেই শিশুদের উপর বর্ষিত বোমার জ্বালানি যদি হয় আমার আপনার হজের অর্থ—তবে আমাদের চোখের জলের ওজু দিয়ে আর কিসের শুদ্ধি হবে?
আজ প্রয়োজন এক ঈমানদীপ্ত বিকল্প চেতনার। যেখানে হজ হবে বিশুদ্ধ ইবাদত, অপচয় নয়। হজ হবে আত্মার জাগরণ, অন্যায় রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা নয়। হজ হবে ত্যাগের প্রতীক, বিলাসের নয়। হজ হবে নিঃস্বের হাতে সাহায্য তুলে দেওয়ার হাত, অস্ত্রবান রাষ্ট্রকে সমর্থনের হাত নয়।
আত্মশুদ্ধির নামে যেন আর কখনো আত্মঘাতী অর্থনীতির বাহক না হই আমরা। হজ হোক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, কোনো যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রের বাজেট বৃদ্ধির উৎস নয়।
লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর