১২ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৭ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

একটা সম্পর্কে আছেন, তবু আরেকজনকে ভালো লাগছে—কি করবেন?

ইমতিয়াজ উদ্দিন:

সম্পর্কে থেকেও হঠাৎ অন্য কারও প্রতি ভালো লাগা অনুভব করা অনেকের জীবনে ঘটে। অফিসে, ভার্সিটিতে কিংবা সামাজিক কোনো প্ল্যাটফর্মে কারও ব্যবহার, কথা বলা বা মনোভাব আকৃষ্ট করতে পারে। তখন মনের ভেতরে প্রশ্ন জাগে—আমি তো একটা সম্পর্কে আছি, কিন্তু তবুও কেন অন্য একজন ভালো লাগছে? এটা কি বিশ্বাসঘাতকতা? কিংবা এই ভালো লাগার ভিত্তিতে আমি কি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হলে প্রথমেই উপলব্ধি করতে হবে—ভালো লাগা এক জৈবিক প্রতিক্রিয়া হলেও, সম্পর্ক এক সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা। আমরা অনুভব করতেই পারি, কিন্তু সেটি গ্রহণ বা প্রতিহত করাই আমাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সম্পর্কের প্রতি সম্মান প্রকাশ করে।
সত্যিকারের প্রেম মানে শুধু আকর্ষণ নয়—দায়িত্ব, প্রতিশ্রুতি এবং ত্যাগ।

ভালো লাগা আসলে মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া, মনের নয়।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, নতুন কিছু দেখলেই মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন ক্ষরণ বাড়ে। ডোপামিন হলো আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করা একটি নিউরোট্রান্সমিটার। তাই নতুন একজনের হাসি, গুণাবলি বা ব্যক্তিত্ব সাময়িকভাবে আকর্ষণীয় লাগতেই পারে।

কিন্তু মনোবিদরা বলেন,

“এই মুহূর্তিক অনুভবকে সত্যি প্রেম ভাবার আগে বুঝে নিতে হবে—আপনি যা অনুভব করছেন, তা মাথার রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া, মন ও সম্পর্কের গভীরতা নয়।”

সুতরাং এটি কোনো ‘পাপ’ নয়, কিন্তু এটিকে গুরুত্ব দেওয়া মানেই আপনি নিজের সম্পর্ককে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন।

বর্তমান সম্পর্ক: আপনার জীবনের বাস্তব ও শ্রদ্ধার জায়গা
একটি সম্পর্ক সময়, আত্মত্যাগ, ভরসা আর বিশ্বাস দিয়ে তৈরি হয়। এই সম্পর্কটিকে শুধু ‘বাধ্যবাধকতা’ নয়, বরং ‘নিরাপদ আবেগের আশ্রয়’ হিসেবে দেখতে শিখতে হবে। যদি হঠাৎ অন্য কেউ ভালো লাগে, তখন প্রশ্ন করা উচিত—আমার বর্তমান সম্পর্কের কোথায় ঘাটতি পড়েছে?

এটি কোনোভাবেই সম্পর্ক ছাড়ার বা দ্বিতীয় কারও দিকে যাওয়ার অজুহাত হতে পারে না। বরং এই মুহূর্তটিই হলো আপনার প্রেমিক বা জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ।

বিশ্বখ্যাত দাম্পত্য গবেষক Dr. John Gottman বলেন,

“সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ এলেই পালিয়ে যাওয়া নয়—সেটিকে একত্রে মেরামত করাটাই সত্যিকারের প্রেম।”

সমাধান: কীভাবে সম্পর্ক বাঁচাবেন ও ভালো লাগার মোহ কাটাবেন?

১. নিজের ভালো লাগার উৎস চিহ্নিত করুন:

নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন—এই নতুন ভালো লাগার মূল কারণ কী?

আপনি কি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন সম্পর্কের নিয়মে?

আপনি কি আপনার সঙ্গীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত যত্ন পাচ্ছেন না?

আপনি কি আবেগগতভাবে ক্লান্ত?

এই প্রশ্নগুলো সম্পর্কের ভেতরের সমস্যাগুলো খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে—যা সমাধানযোগ্য।

২. সঙ্গীর সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বলুন:

ভালোবাসা মানেই খোলামেলা যোগাযোগ। সম্পর্কের দূরত্ব, একঘেয়েমি বা মানসিক শূন্যতার কথা সঙ্গীর সঙ্গে ভাগ করে নিন। আপনি যা অনুভব করছেন তা লুকিয়ে রাখলে সমস্যা বাড়বে। বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দুজন মিলে নতুন পরিকল্পনায় ফিরতে পারবেন—হয়তো আবারও প্রেমে পড়বেন।

৩. পুরনো সম্পর্ককে নতুনভাবে আবিষ্কার করুন:

যেকোনো প্রেমিক-প্রেমিকা বা দম্পতির জন্য খুবই কার্যকর একটি কৌশল হলো “Intentional Romance Rediscovery” অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে একে অপরকে নতুন করে জানার চেষ্টা করা। একসঙ্গে সময় কাটানো, পুরোনো দিনের স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া, ছোট ছোট উপহার দেওয়া—এসব সম্পর্ককে উজ্জীবিত করে।

৪. সৃজনশীলভাবে সময় দিন:

অনেক সময় একঘেয়েমি থেকেই মন অন্যদিকে ছুটে যায়। আপনি ও আপনার সঙ্গী মিলে নতুন কিছু করতে পারেন:

ক) একসঙ্গে বই পড়া

খ) রান্না করা

গ)সিনেমা দেখা

ঘ) ঘুরতে যাওয়া

ঙ) নতুন অভ্যাস গড়ে তোলা

এসব কাজ আবার সম্পর্কের মধ্যে বন্ধন জাগিয়ে তোলে।

 

৫. আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মশৃঙ্খলা চর্চা করুন:

জীবনের অনেক বড় অর্জন আসে বর্জনের মাধ্যমে, আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে।
একজন নতুন মানুষের প্রতি সাময়িক আকর্ষণ কাটিয়ে নিজেকে ভালোবাসার পথে ধরে রাখাটা এক ধরনের বিজয়। আপনি তখন শুধু সম্পর্কই বাঁচালেন না, নিজের আত্মমর্যাদাও টিকিয়ে রাখলেন।

নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়িত্ব:

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় একটি সম্পর্ক শুধু দুই ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্ক নয়, বরং তা দুই পরিবারের, সমাজের ও সংস্কৃতির অংশ। ধর্মীয়ভাবেও প্রতিটি বিশ্বাস ব্যবস্থা মানুষকে দায়িত্ববান ও একনিষ্ঠ থাকতে শেখায়।
ইসলামে একাধিক সম্পর্ক, প্রতারণা ও সম্পর্কের বাইরে আকর্ষণকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

পৃথিবীর সব ধর্ম, দর্শন ও নৈতিকতা—একটি কথাই বলে:

“যে ভালোবাসে, সে দায়িত্ব নেয়, পালায় না।”

ভালো লাগা আসবেই, আপনি কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন সেটাই আসল বিষয়।
একটি সম্পর্কে থাকা অবস্থায় অন্য কারো প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা হয়তো স্বাভাবিক, কিন্তু সেটিকে গুরুত্ব দেওয়া কতটা নৈতিক, কতটা সঠিক—সেই বিচার আপনাকেই করতে হবে।

আপনি যদি সত্যিকার অর্থে আপনার সঙ্গীকে ভালোবাসেন, তাহলে এই ভালো লাগার মোহকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করুন। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখুন, সম্পর্ককে পূর্ণতা দিন। কারণ একবার হারিয়ে গেলে সেই সম্পর্ক, সেই বিশ্বাস—আর কখনো ফিরিয়ে আনা যায় না।

লেখক – জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top