মইনুদ্দিন চিশতী, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখার ছত্রচ্ছায়ায় এক ‘অভিনব প্রভাবশালী’ অফিস সহায়ক বারবার নিজের সুবিধামতো বদলি নিচ্ছেন বিভিন্ন উপজেলায়। গত তিন বছরে ছয়বার বদলি হওয়া এই কর্মচারী বর্তমানে কর্ণফুলী উপজেলা ভূমি অফিসে কর্মরত। তার নাম মো. তৌহিদুল আলম।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টরদের ‘ম্যানেজ’ করে নিজ পছন্দসই জায়গায় বদলি নিচ্ছেন। বিশেষ করে যেখানে দুর্নীতির সুযোগ ও অর্থনৈতিক সুবিধা বেশি—সেই অফিসেই পদায়নের প্রবণতা স্পষ্ট।
বিভিন্ন দপ্তরের আদেশ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর লোহাগাড়া উপজেলা ভূমি অফিস থেকে তৌহিদুল আলমকে বদলি করা হয় সন্দ্বীপ উপজেলার মাইটভাঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। সেখান থেকে ৭ ডিসেম্বর বদলি হন বোয়ালখালী উপজেলার সরোয়াতলী ইউনিয়নে।
২০২৩ সালের ১৪ মে বোয়ালখালী থেকে তাকে পটিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে বদলি করা হয়। এরপর ২০২৪ সালের ২০ আগস্ট বদলি হন মিরসরাই উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নে। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ২১ মে বদলি হয়ে তিনি কর্ণফুলী উপজেলা ভূমি অফিসে যোগ দেন।
তিন বছরে ছয়বার বদলির ঘটনাকে অস্বাভাবিক মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ—এই অফিস সহায়ক নিজের সুবিধামতো পোস্টিং নিচ্ছেন প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পটিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে কর্মরত থাকাকালে সেবাগ্রহীতাদের জিম্মি করে টাকা আদায়, প্রকাশ্য ঘুষ গ্রহণ, গোপন বালাম বই অনুমতি ছাড়া বের করে খতিয়ান সরবরাহসহ নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, অফিসের অন্যান্য কর্মচারীদের তিনি রাজনৈতিক শক্তির ভয় দেখিয়ে দমন করতেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বিগত সরকারের সময় তৌহিদুল নিজেকে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দিয়ে আধিপত্য চালাতেন। নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শুরু করে নৌকার পক্ষে পথসভা—সবখানে সরকারি কর্মচারী হয়েও ছিলেন সরব। তার রাজনৈতিক তৎপরতার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনো রয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বহু প্রভাবশালী মন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালালেও তৌহিদুল আলম বহাল তবিয়তে আছেন। বরং বর্তমান শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন সত্ত্বেও তার প্রতাপ যেন অটুট। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখায় এখনো তার খুঁটির জোর কোথায়?
চট্টগ্রামের একটি উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি), নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, “প্রায়ই দেখা যায় রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টরের অফিস থেকে হঠাৎ কোনো অফিস সহায়কের বদলির আদেশ আসে—তাও একাধিকবার। আমরা কারণ জানতে চাইলেও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না।”
এই পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একজন অফিস সহায়কের বারবার পছন্দের স্থানে বদলির রহস্য উদঘাটন ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনের হস্তক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অফিস সহায়ক মো. তৌহিদুল আলম বলেন, ‘কতৃপক্ষ আমাকে বদলি করলে আমি কি করব। আমি তো তদবির করে বদলি করেছি এ রকম কোন প্রমাণ নেই।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রাজস্ব শাখার রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) পান্না আক্তার বলেন, ‘যে কোন বদলি করার পেছনে কয়েকটি কারণ থাকে। কোন না কোন অভিযোগ পেলে আমরা বদলি করে থাকি। সম্ভবত তার বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ ছিলো তাই বদলি করা হয়েছে। আর আমার স্বাক্ষরিত আদেশে বদলি হলেও সেটা জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশে হয়ে থাকে। স্যার যখন অনুমোদন করেন, তখন আমি স্বাক্ষর করি।’
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সাদি উর রহিম জাদিদ বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। কেউ অভিযোগও করেনি। তবে আমি বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছি। তারপর যদি কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার থাকে নেওয়া হবে।