জাকির হোসেন হাওলাদার, দুমকী ও পবিপ্রবি প্রতিনিধি :
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পবিপ্রবি) সহকারী রেজিস্ট্রার (খণ্ডকালীন) মো. মাহমুদ আল জামানের প্রকাশ্য আক্রমণের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও প্রতিবেদন জমা দেয়নি। ঘটনার এক মাস ছয় দিন অতিক্রান্ত হলেও রিপোর্ট না আসায় শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১৩ আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রশাসনিক ভবনের রেজিস্ট্রার শাখায় সহকারী রেজিস্ট্রার মাহমুদ আল জামান প্রকাশ্যে সেকশন অফিসার সাকিন রহমানকে অফিসকক্ষে চরথাপ্পড় মারেন।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, এ ধরনের আচরণ শুধু কর্মপরিবেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং সহকর্মীদের জন্য আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।ঘটনার পরপরই ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু দীর্ঘ ৩৬ দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো প্রতিবেদন জমা হয়নি।
কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. মুহসিন হোসেন খান বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন করা। অবিচার না হয় সে জন্য কিছুটা সময় নিচ্ছি।” তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা মনে করছেন—এমন দীর্ঘসূত্রিতা তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং দোষীকে বাঁচানোর জন্য প্রভাবশালী মহলের চেষ্টা চলছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, কর্মস্থলে সহকর্মীকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা শুধু শ্রম আইন নয়, সরকারি কর্মচারীদের আচরণবিধি এবং মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও শামিল। সাবেক শিক্ষার্থী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আমিনুল ইসলাম বলেন, “এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে। তদন্ত প্রক্রিয়ায় জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।”
ভুক্তভোগীর অভিযোগ: আহত সেকশন অফিসার সাকিন রহমান বলেন, “সবার সামনে আমাকে আঘাত করে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসা শেষে এখনো মানসিক আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
অভিযুক্তকে রক্ষার চেষ্টা চলছে—এটি অত্যন্ত হতাশাজনক। আমি ন্যায়বিচার চাই।” এ বিষয়ে প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. এস. এম. হেমায়েত জাহান বলেন, “কর্মস্থলে সহকর্মীর ওপর শারীরিক আক্রমণ গুরুতর অপরাধ।
তদন্ত দ্রুত শেষ করে সত্য প্রকাশ করা হবে।”ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলামও জানিয়েছেন, “শৃঙ্খলাভঙ্গ কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ : বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের কাছে অভিযুক্ত কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতির দাবি জানিয়েছেন। তাদের হুঁশিয়ারি—“রিপোর্ট জমা দিতে দেরি হলে বা অভিযুক্তকে বাঁচানোর চেষ্টা হলে কঠোর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবো।”
অভিযুক্ত সহকারী রেজিস্ট্রার মাহমুদ আল জামান পূর্বেও নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এক ছাত্রীর সঙ্গে একতরফা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
বিষয়টি প্রকাশ পেলে ছাত্রীটির হাতে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত হন এবং মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের সঙ্গেও অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং শারীরিক আক্রমণের অভিযোগে একাধিকবার পারিবারিক বিচারের মুখোমুখি হন।পরিবারের রাজনৈতিক প্রভাব ও আত্মীয়তার সুযোগে জামান ঢুকে পড়েন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে।
তার চাচাতো মামা বাকেরগঞ্জ উপজেলার নলুয়ার মরহুম মোহাম্মদ আলী ফারুক তালুকদার ও মামী সাবেক সাংসদ শাহনাজ পারভীন তালুকদার মায়ার (সাবেক আওয়ামীলীগ দলীয় এমপি) মালিকানাধীন “প্রীটি গ্রুপে” চাকরি পান।
সেখানে কয়েক বছর চাকরি করে প্রীটি গ্রুপ এরই কোটি টাকা চুরি করেন। তবে কোটি টাকার মালিক হলেও পরবর্তীতে প্রতারণার অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রীটি গ্রুপ কর্তৃপক্ষ তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে। পরে পারিবারিক সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়। এরপর পবিপ্রবির প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. এস. এম. হেমায়েত জাহানের সুপারিশে এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মাহমুদ আল জামানকে সহকারী রেজিস্ট্রার (খণ্ডকালীন) পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
শুধু জামান নন, তার ছোট ভাই রাজিব খানও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তিনি একসময় পবিপ্রবি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন এবং পরবর্তীতে পুলিশের এসআই পদে চাকরি পান।
দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে ওসি হলেও গত জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের পর তাকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ—আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের বহু নেতাকর্মীর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালান।অভিযুক্ত মাহমুদ আল জামানের পারিবারিক সূত্র জানায়, তিনি বিবাহ করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ছোট চাচা ,আব্দুর রব খানের মেয়েকে।
আবার তার মেঝ শালিকা বিবাহ করেছেন পবিপ্রবি ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডার ও বর্তমান ডেপুটি রেজিস্ট্রার তানজিলুর রহমান তানজিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে ল্যাপটপ চুরির অভিযোগে ছাত্রত্ব হারাতে বসা এই তানজিল পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পবিপ্রবির প্রভাবশালী ভিসিদের ছত্রচ্ছায়ায় নিয়োগ–টেন্ডার বাণিজ্য করে কোটি টাকার মালিক বনে যান।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন—জামান ও তার আত্মীয়রা দুই সরকারের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) সময়ই ক্যাম্পাসে চুরি, ঘুষ ও প্রভাব বিস্তারের রাজনীতি চালিয়ে গেছে। কর্মকর্তাদের মতে, যোগদানের পর থেকেই মাহমুদ আল জামান বিভিন্ন সময়ে আচরণবিধি ভঙ্গ ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করে আসছেন, যা প্রশাসনিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে তার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
তাদের আশঙ্কা—এখনই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে চাকরি স্থায়ী হলে মাহমুদ আল জামান সহকর্মীদের জীবন ও নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হুমকিতে পরিণত হতে পারেন।
এক মাস ছয় দিন পেরিয়ে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ায় পবিপ্রবির শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে তীব্র প্রশ্ন তুলছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, ঘটনার দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে প্রশাসনিক পরিবেশ ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আর বিশ্ববিদ্যালয় গভীর অচলাবস্থার মুখে পড়তে পারে।