মো. সাইফুল ইসলাম, নীলফামারী প্রতিনিধি:
নীলফামারীতে গত বছরের লোকসানের ক্ষত এখনো শুকোয়নি, এর মধ্যেই কৃষকরা ঝুঁকি নিয়ে আবারও আগাম আলু চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাজারে আলুর দাম নেই, হিমাগারে রাখা আলুও কম দামে বিক্রি হচ্ছে। তারপরও কৃষকরা স্বপ্ন দেখছেন—আগাম মৌসুমে ফলন ভালো হলে বাজারে চড়া দামে আলু বিক্রি করতে পারবেন।
এদিকে,ভালো দামের আশায় কৃষকরা শীতের আগেই মাঠজুড়ে আগাম জাতের আলু রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আউশ ও আগাম আমন কাটার পর সেই জমিতেই জমি প্রস্তুত, সার প্রয়োগ করে হিমাগার থেকে আনা বীজ রোপণ করছেন তারা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এক কেজি আলু ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি সম্ভব।
কৃষিনির্ভর এ জেলায় বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ উপজেলা আগাম আলুর জন্য পরিচিত। স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় ‘সেভেন’ জাতের আলু ৫০–৬০ দিনে তোলা যায়, আর বাজারে এর চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি থাকায় কৃষকের আগ্রহও বাড়ছে।
আলু শীতপ্রধান ফসল হলেও জলবায়ুর অস্থিরতা এখন চাষিদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শরতে শীতের আমেজ শুরু হলেও দিনের বেলায় তীব্র গরমে আলু দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া মৌসুমে অকাল বৃষ্টিপাত হলে ফসল নষ্ট হয়ে নতুন করে একই জমিতে আলু রোপণ করতে হয়। ফলে আগাম জাত না হয়ে আলু পরে সাধারণ ভ্যারাইটিতে চলে যায়, তখন বাজারে দাম পড়ে যায় এবং চাষিদের লোকসান গুনতে হয়।
বর্তমানে নীলফামারীর হিমাগারগুলোতে রাখা বিনা-৭ জাতের আলুর দাম কেজিপ্রতি মাত্র ১১ থেকে ১২ টাকা। অথচ উৎপাদন খরচ অনুযায়ী প্রতি কেজির দাম দাঁড়িয়েছে অন্তত ৩০ টাকা। বীজ আলু ১৩ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাকিতে বিক্রি করলে দাম কিছুটা বাড়িয়ে ২০ থেকে ২৪ টাকা পাওয়া যায়। তবে বাজারে অন্যান্য সবজির দাম চড়া হলেও আলুর দাম বাড়ছে না, যা কৃষকদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার বিশিষ্ট আলুচাষী ও ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান লুতু জানান,“গত মৌসুমে হিমাগারে প্রায় ২ হাজার ৫০০ বস্তা আলু রেখেছিলাম। দামে না থাকায় লোকসান গুনেছি। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে আবারও আগাম বিনা-৭ জাতের আলু রোপণ করেছি। হিমাগার থেকে ৭ শ বস্তা আলু এনে ১৩ বিঘা জমিতে লাগিয়েছি। বাকি আলু ১৮ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে বীজ হিসেবে বিক্রি করছি। অথচ খরচ অনুযায়ী আলুর দাম ৩০ টাকা হওয়া দরকার।”
ওই এলাকার ইয়াসিন আলী বলেন, দাম না থাকলেও নীলফামারীতে থেমে নেই আগাম আলু চাষ। গত বছরের লোকসানের ক্ষত সারেনি, তবু চাষিরা আশায় বুক বেঁধে ঝুঁকি নিচ্ছেন। বাজারে নতুন আলুর দাম কেজিতে ১০০ টাকার ওপরে থাকলেও প্রকৃতির চ্যালেঞ্জ বড় বাধা। দিনে গরম, রাতে শীত, সঙ্গে বৃষ্টির আশঙ্কা—সব মিলিয়ে আলু নষ্ট হলে আবার রোপণ করতে হয়। এতে আগাম নয়, মাঝামাঝি মৌসুমের ফসল হয়ে লোকসান ঝুঁকিই বাড়ে।
অন্য এক কৃষক নিপুল কর্মকার বলেন, “দুর্গাপূজার বিসর্জনের সময় প্রবল বর্ষণে ফসলহানির শঙ্কা থাকে। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে ৪ বিঘা জমিতে আলু রোপণ করেছি। ঘরে আরও আলু জমে আছে। ক্ষতি হলে আবার আলু রোপণ করব।”
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মঞ্জুর রহমান জানান, এ পর্যন্ত জেলায় প্রায় ১০ হেক্টর জমিতে আগাম আলুর রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। গত বছর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ৭ হাজার ১৫ হেক্টর জমিতে আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়। গোটা জেলায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ২২ হাজার হেক্টর, যা সফলভাবে পূরণ হয়েছে।
প্রতি বছর নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলাতেই দেশের প্রথম আগাম আলু ওঠে। মৌসুমের শুরুতে বাজারে নতুন আলুর দাম সাধারণত ১০০ টাকার ওপরে থাকে। সেই আশাতেই কৃষকরা লোকসান ঘোচাতে ঝুঁকি নিয়ে আগাম আলু চাষ করছেন। তবে আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বাজার অস্থিরতা তাদের স্বপ্নকে যেকোনো সময় ধসিয়ে দিতে পারে।
কৃষকরা বলছেন, ন্যায্যমূল্য না পেলে এ বছরও বড় ক্ষতির শিকার হবেন তারা। তাই সরকারের কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনা ও কৃষকদের উৎপাদন খরচ অনুযায়ী দাম নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।