মোঃ হাছান আল মামুন, দীঘিনালা (খাগড়াছড়ি) প্রতিনিধি:
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার উত্তরের প্রান্তে অবস্থিত সবুজে ঘেরা দীঘিনালা উপজেলা। পাহাড়, ঝিরি ও টিলায় ঘেরা এ জনপদে প্রকৃতি যেমন দানশীল, তেমনি এখানকার মানুষও পরিশ্রমী। কৃষিনির্ভর এ এলাকার অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হলুদ, আদা, কলা ও জুমচাষ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশে থাকা এ কৃষিপণ্যই এখন দীঘিনালার মানুষের জীবিকার অন্যতম অবলম্বন।
কলা চাষে বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ জীবন
দীঘিনালার পাহাড়ি ঢাল আর উর্বর টিলাগুলোতে এখন সর্বত্রই দেখা যায় কলার বাগান। উপজেলার মেরুং, বোয়ালখালী, বাবুছড়া, কবাখালী ও সদর ইউনিয়নে হাজার হাজার কৃষক এখন কলা চাষে যুক্ত।
জামতলীর কলা চাষী আফজাল হোসেন জানান, কলা চাষে খরচ কম, শ্রম বেশি নয়, আর বাজারে চাহিদাও স্থায়ী। স্থানীয় কৃষক ধনলয় চাকমা বলেন, মাত্র এক একর জমিতে কলা চাষ করে বছরে প্রায় দুই লাখ টাকা আয় করা যায়। সময়মতো যত্ন নিলে ফলন খুবই ভালো হয়।”
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, দীঘিনালায় প্রতিবছর প্রায় ১,৮০০ একর জমিতে কলা চাষ করা হয়, যার বাজারমূল্য কোটি টাকার উপরে।
হলুদ ও আদা— পাহাড়ের সোনালী সম্পদ পাহাড়ি মাটিতে স্বাভাবিকভাবে জন্মে হলুদ ও আদা। দীঘিনালার প্রায় প্রতিটি গ্রামে এ দুটি ফসল চাষ হয়। বিশেষ করে জুম চাষের সঙ্গে মিলিয়ে স্থানীয়রা পাহাড়ের ঢালে হলুদ ও আদা রোপণ করেন।
ফসল পরিপক্ব হওয়ার পর সেগুলো স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে চলে যায় জেলার বাইরে— চট্টগ্রাম, ফেনী এমনকি ঢাকার পাইকারি বাজারেও।
স্থানীয় নারী কৃষক পুতি চাকমা বলেন, আমাদের হলুদ ও আদা বিক্রি করে ঘরে নগদ টাকা আসে। মেয়েদের হাতেও এখন অর্থ উপার্জনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।”
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর দীঘিনালা থেকে প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন আদা ও ১ হাজার মেট্রিক টন হলুদ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
জুমচাষ— পাহাড়ের ঐতিহ্য ও জীবনধারা
জুমচাষ শুধুমাত্র কৃষি নয়, এটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির অংশ। শতাব্দী প্রাচীন এ চাষ পদ্ধতিতে ধান, মরিচ, তিল, কুমড়া, শিম, মিষ্টি আলুসহ নানা ফসল একসঙ্গে চাষ করা হয়।
এতে একদিকে পরিবারের খাদ্যচাহিদা পূরণ হয়, অন্যদিকে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রির মাধ্যমে আয়ও হয়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.শাহাদাত হোসেন বলেন “দীঘিনালার প্রায় ১,২০০ হেক্টর জমিতে জুমচাষ হয়। এটি পাহাড়ের খাদ্যনিরাপত্তা ও স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।” তিনি বলেন আমরা মসলা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কৃষকদেরকে সাহায্য করে থাকে, যেমন বস্তায় আদা চাষ হলুদ চাষ এবং বিভিন্ন শাকসবজি।
বাজার ও বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু দীঘিনালা সদর, বোয়ালখালী, মেরুং ও বাবুছড়া বাজারকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি অর্থনীতি আবর্তিত হচ্ছে। সপ্তাহে ৪ দিন বসা এসব হাটে পাহাড়ি কৃষকরা তাদের উৎপাদিত কলা, আদা, হলুদ ও অন্যান্য জুমফসল বিক্রি করেন।
পাইকাররা এখান থেকে ট্রাকে করে এসব পণ্য নিয়ে যান খাগড়াছড়ি, রামগড় ও চট্টগ্রামের বাজারে। ব্যবসায়ী জাফর ইকবাল বলেন, পাহাড়ের হলুদ আর আদার স্বাদ আলাদা। তাই চট্টগ্রামের বাজারে এগুলোর চাহিদা সবসময় বেশি থাকে।
দীঘিনালার অর্থনীতির প্রাণভোমরা এখন পাহাড়ের এই কৃষিপণ্য। কলা, আদা, হলুদ ও জুমফসলের সাফল্য শুধু কৃষকের জীবনমানই বদলাচ্ছে না, বরং গড়ে তুলছে এক টেকসই স্থানীয় অর্থনৈতিক কাঠামো।
পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানুষের পরিশ্রম একত্রে গড়ে তুলছে এক সবুজ ও সম্ভাবনাময় দীঘিনালা— যা দেশের কৃষি অর্থনীতির মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠছে।