মোঃ আমিরুল হক, রাজবাড়ী প্রতিনিধি:
দেশের শিক্ষাঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে কোচিং বাণিজ্যের চরম দৌরাত্ম্য। ২০১৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রকাশিত “কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা” অনুযায়ী কোনো শিক্ষক তার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। কিন্তু এমন একটি শক্ত নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও মাঠপর্যায়ে এর কোনো বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। ফলে প্রশ্নের মুখে পড়েছে শিক্ষকতার নৈতিকতা এবং শিক্ষাব্যবস্থার সুষ্ঠু বিকাশ। অন্যদিকে বিভিন্ন উপজেলা শিক্ষা অফিস চোখে কালো পর্দা পড়ে রয়েছে।
২০১২ সালে জারি হওয়া নির্দেশনার ভিত্তিতে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশে ২০১৯ সালে এই নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং করাতে পারবেন না,অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ ১০ জনকে প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ থাকবে, তা-ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের লিখিত অনুমতি সাপেক্ষে।কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব নিয়ম শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত স্কুল – কলেজ শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য চলছে প্রকাশ্যে।
একাধিক অভিভাবকের করা অভিযোগে জানা যায়, অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠ অসম্পূর্ণ রেখে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেন তাদের ব্যক্তিগত কোচিংয়ে যোগ দিতে। রাজবাড়ী জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে দেখা যায়, স্কুল ছুটির পর শ্রেণিকক্ষেই কোচিং ক্লাস চলছে। কেউ কেউ আবার স্কুলের পাশেই নিজস্ব কোচিং সেন্টার গড়ে তুলে ব্যবসা করছেন বহাল তবিয়তে।
অভিযোগ রয়েছে, কোচিংয়ে না গেলে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় নাম্বার কম দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। এতে তারা মানসিক চাপে পড়ে যায়। যার কারণে পড়ালেখায় অনাগ্রহী হয়ে পড়ছে অনেক শিক্ষার্থী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, “স্যার ক্লাসে ঠিকভাবে পড়া বোঝান না। বলেন, কোচিংয়ে পড়লে সবই বুঝতে পারবে। যারা কোচিংয়ে যায়, তারা পরীক্ষায় ভালো নম্বর পায়, আর যারা তাদের কাছে কোচিং করতে না যায়, তাদের নাম্বার দিতে উপেক্ষা করা হয়।”
রাজবাড়ীর বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষকদের ব্যক্তিগত কোচিংয়ে অংশ নিতে শিক্ষার্থীদের প্রতি মাসে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়। ব্যাক্তিগতভাবে একা পড়তে চাইলে খরচ আরও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীগুলো পড়ে যায় মারাত্মক অর্থনৈতিক চাপে।
ইতিমধ্যে যশোরের কেশবপুরে তো প্রাইভেট কোচিং না করায় এক শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর ওপর হামলা চালানোর অভিযোগও উঠেছে। যা শিক্ষকতার নৈতিকতা ও মানবিকতার চরম লঙ্ঘন।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর ২০২৩ সালের তথ্যে দেখা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ের ৭২% শিক্ষক কোনো না কোনোভাবে কোচিং বা প্রাইভেট টিউশনের সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে ৫৩% শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরই পড়ান। ৪৭% শিক্ষক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষেই ছুটির পর কোচিং করান। এই বাস্তবতা শিক্ষকদের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নীতিমালায় বলা আছে, অভিভাবকদের অনুরোধে প্রতিষ্ঠান প্রধান বিদ্যালয়ের নির্ধারিত সময়ের বাইরে অতিরিক্ত ক্লাস নিতে পারেন।এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ মহানগরে ৩০০ টাকা, জেলা পর্যায়ে ২০০ টাকা, উপজেলা পর্যায়ে ১৫০ টাকা নেওয়া যাবে।
তবে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ছাড় বা মওকুফের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এসব ক্লাসের আয়ের নির্দিষ্ট অংশ বিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেওয়ারও বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে এসব নিয়মের কোনোটিই মানা হচ্ছে না।
বিল্লাল হোসেন নামে এক অভিভাবক বলেন, “কলেজে ক্লাস হয় না ঠিকমতো। তাই দুই মেয়ের জন্য আলাদা প্রাইভেট টিচার রাখতে হচ্ছে। এতে মাসে প্রায় ৬ হাজার টাকা খরচ বেড়েছে। এতে সংসারে চরমভাবে চাপ পড়ে যাচ্ছে।”
অন্য এক অভিভাবক জানান,“আমার মেয়ে কোচিংয়ে যায় না বলে স্যার সরাসরি বলেছেন, পরীক্ষায় বুঝে নেবে। বাধ্য হয়ে কোচিংয়ে পাঠাতে হচ্ছে।”
ব্র্যাকের এক জরিপে দেখা যায়, ৬১% শিক্ষার্থী মনে করে কোচিং ছাড়া ভালো ফলাফল করা সম্ভব নয়। ৪৩% শিক্ষার্থী আশঙ্কা করে শিক্ষকরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের কম নম্বর দিতে পারেন। এই ভয় ও চাপ শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা, বিষণ্নতা ও আত্মবিশ্বাসহীনতা তৈরি করছে।
শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, “একজন মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অধীনে প্রায় ৩০-৫০টি বিদ্যালয় থাকে। ফলে নিয়মিত তদারকি অসম্ভব।”এ ছাড়া প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রভাবের কারণেও অনেক শিক্ষক শাস্তির বাইরে থাকেন। ফলে তারা নির্ভয়ে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।
রাজবাড়ীর প্রবীণ সাংবাদিক সমীর কান্তী বিশ্বাস বলেন,“শ্রেণিকক্ষ এখন অনেক শিক্ষকের কাছে শুধু সময় পার করার জায়গা। কোচিং তাদের মূল আয় ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু।” ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অনেক শিক্ষক কোচিং বা টিউশন করেন ক্লান্ত অবস্থায় স্কুলে আসেন। অনেক শিক্ষক ক্লাস টাইমে চেয়ারে বসেই ঘুমের কাজটি সেরে নেন।
রাজবাড়ী জজ কোর্টের আইনজীবী এ্যাডভোকেট রোকনুজ্জামান বলেন, “শিক্ষকেরা যদি ক্লাসে পাঠদান না করে বাইরে কোচিং করান, তাহলে তারা শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের শত্রু হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। ”তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।”
শিক্ষা গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, নীতিমালা থাকলেও বাস্তবায়নের অভাবেই কোচিং বাণিজ্য এখন নিয়ন্ত্রণহীন। প্রশাসনিক শক্তি বৃদ্ধি, কার্যকর নজরদারি এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া এই পরিস্থিতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।
নীতিমালা আছে, আইনও আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। ফলে শিক্ষার পবিত্র ক্ষেত্র ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার মঞ্চে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকতার মহৎ পেশা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা পড়েছেন অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই যদি কোচিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষাজীবন বিপন্ন হবে, আর মেরুদণ্ডহীন শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে অন্ধকারের পথে ঠেলে দেবে।