৩০শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৮ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

নিয়াজ মাখদুম খোতানী রহ. ইলমের প্রদীপ, যিনি নিজে নিভে গিয়েও রেখে গেছেন আলো

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান:

বাংলার মাটি বহু গুণী সন্তানের পদচিহ্নে ধন্য। যাঁরা এসেছিলেন দূর দেশ থেকে, কিন্তু এখানকার মানুষ ও মাটির সঙ্গে মিশে গেছেন নিজেদের সবটুকু জ্ঞান, হৃদয় ও ভালোবাসা বিলিয়ে। তেমনি এক মহীয়ান আত্মা ছিলেন আল্লামা নিয়াজ মাখদুম খোতানী (রহ.) একজন হাদীসবিশারদ, একজন শিক্ষক, এবং সর্বোপরি একজন সন্ন্যাসী আত্মার অধিকারী আলেম, যাঁর আলো এখনো বাংলাদেশের ইসলামী শিক্ষাঙ্গনে দীপ্ত।

রুশীয় তুর্কিস্থানের খোতান প্রদেশের আকাশের নিচে তাঁর জন্ম। পরবর্তীতে যাযাবরপথ ধরে তিনি ভারতবর্ষে, আর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন। হিজরতের এই পথ তাঁর জীবনের প্রতীক হয়ে ওঠে যেখানে দুনিয়ার সব সীমান্ত মুছে যায়, কেবল জ্ঞান, বিশ্বাস ও মানবসেবার সীমাহীন সীমানা উন্মুক্ত থাকে।

ছোটবেলা থেকেই তাঁর মন ছিল জ্ঞানের প্রতি নিবিষ্ট। শাস্ত্রপাঠে তিনি ছিলেন অগাধ। কুরআন, হাদীস, ফিকহ, তাসাউফ সব শাখাতেই তাঁর ছিল গভীর দখল। তবে যেটি তাঁকে আলাদা করে তুলেছিল, তা হলো হাদীস বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর অগাধ মমতা ও নিরলস অধ্যয়ন। তিনি বলতেন, “হাদীস হলো ইসলামের হৃদস্পন্দন, এর আলোয় না ভিজলে জ্ঞানের শরীর কখনো সম্পূর্ণ হয় না।”

বাংলাদেশে এসে তিনি দীর্ঘকাল ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। হাদীস পড়ানোর তাঁর পদ্ধতি ছিল অনন্য। ছাত্ররা বলেন, তাঁর একবারের দরস মানে যেন এক জীবনের স্মৃতি। তিনি এমনভাবে বুঝিয়ে দিতেন যে, জ্ঞান যেন মুখস্থ নয় মনের গভীরে খোদাই হয়ে যায়। তাঁর মুখের কোমল উচ্চারণে ‘ইলম’ যেন হৃদয়ে ফুল হয়ে ফুটত।

সাধারণ জীবনযাপন ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। বিলাসিতা তাঁর কাছে ছিল নিরর্থক এক শব্দ। তিনি ছিলেন দীননিষ্ঠ, বিনয়ী, এবং মানুষের প্রতি গভীর মমতাশীল। দরিদ্র ছাত্রদের জন্য নিজের সামান্য ভাতা থেকেও অংশ কেটে দিতেন। তাঁর নীরব উপস্থিতিতেই অনেকের জীবনে শুরু হতো পরিবর্তনের এক নতুন অধ্যায়।

১৯৮৬ সালের ২৯ অক্টোবর, বাংলার বাতাসে বিষণ্নতা নেমে আসে সেদিনই তিনি ইন্তেকাল করেন। কিন্তু তাঁর প্রস্থান কোনো শূন্যতা নয়, বরং রেখে যান এমন এক আলোকরেখা, যা আজও হাজারো ছাত্র, শিক্ষক ও অনুসারীর জীবনে দীপ্ত হয়ে জ্বলছে। প্রতিবছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা ও ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর স্মরণে আয়োজিত হয় দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা। ছারছীনা, দারুন্নাজাত সিদ্দিকিয়া, মাদারীপুর ও ঢাকা অঞ্চলে এখনো তাঁর ছাত্ররা গর্বভরে বলেন “আমরা নিয়াজ খোতানীর দরসে বসেছিলাম।”

তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, জ্ঞান কেবল মুখস্থের বিষয় নয়, এটি আত্মার প্রশান্তি, চরিত্রের স্থিতি, আর সমাজের উন্নতির প্রেরণা। তিনি বিশ্বাস করতেন “যে ইলম মানুষকে বিনয় শেখায় না, সে ইলম নয়, সেটি কেবল অহংকারের পোশাক।”

নিয়াজ মাখদুম খোতানী রহ.-এর স্মৃতিতে আজ আমরা ফিরে দেখি এক আলোকিত মানুষকে, যিনি নিজে নিভে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন আলোর শিখা। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, শিক্ষা মানে শুধু পাঠ নয় এটি হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতা, মনের বিনম্রতা, আর মানুষকে মানুষ করার সংগ্রাম।

আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন তাঁর কবরে নূর দান করেন, তাঁর ইলমের ফসল যেন প্রজন্মের পর প্রজন্মে ফলবতী হয়। এই মাটিতে, এই মানুষে, এই চেতনায় আল্লামা নিয়াজ মাখদুম খোতানী রহ. চিরজীবী থাকবেন তাঁর জ্ঞানের আলোয়, তাঁর বিনয়ের সুবাসে, আর তাঁর রেখে যাওয়া অমলিন ভালোবাসায়।

তথ্যসূত্র
মাসিক নতুন বিকাশ ( অক্টোবর ২০২৫)

লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top