নিজস্ব প্রতিনিধি:
বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতির দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেছেন সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, রোববার (৯ নভেম্বর) সকাল থেকে তারা এই কর্মবিরতি শুরু করেন।
এতে দেশের সাড়ে ৬৫ হাজারেরও বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় এক কোটি শিশু শিক্ষার্থীর ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনের মতো বিদ্যালয়ে গেলেও শিক্ষকরা পাঠদান বন্ধ রেখেছেন। ফলে ক্লাস না করেই শিক্ষার্থীদের ফিরে যেতে হচ্ছে।
শিক্ষকদের দাবি ও আন্দোলনের পটভূমি
দশম গ্রেডে বেতন-ভাতা ও পদোন্নতিসহ তিন দফা দাবিতে গত শনিবার (৮ নভেম্বর) থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন সহকারী শিক্ষকরা।
মূলত ১৫ নভেম্বরের পর কর্মবিরতিতে যাওয়ার কথা থাকলেও, শনিবার শাহবাগে “কলম সমর্পণ” কর্মসূচিতে পুলিশের হামলার ঘটনার পর তারা তা এগিয়ে আনেন। ফলে ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’ আজ থেকেই সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়।
বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও পরিষদের অন্যতম নেতা মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন,
“ঢাকায় আমাদের শিক্ষকদের ওপর যে হামলা হয়েছে, তাতে শিক্ষক সমাজ ক্ষুব্ধ। অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আহত হয়েছেন, কেউ কেউ হাসপাতালে ভর্তি। কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা দেশব্যাপী কর্মবিরতি পালন করছি, এবং দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবো। সরকার যদি দাবি না মানে, প্রয়োজনে বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।”
বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে শঙ্কা
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী, আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। অর্থাৎ পরীক্ষার বাকি মাত্র তিন সপ্তাহ। এমন সময়ে শিক্ষকরা আন্দোলনে নামায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা শঙ্কায় পড়েছেন।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রজব আলী, যার সন্তান পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে এবং বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেবে, বলেন—
“১৫-১৬ বছর পর আবার বৃত্তি পরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষকদের ধর্মঘটে ক্লাস বন্ধ থাকলে প্রস্তুতি নষ্ট হয়ে যাবে। এতে বাচ্চাদের ক্ষতি হবে।”
এক বছরে দ্বিতীয় দফায় কর্মবিরতি
চলতি বছরে এটি প্রাথমিক শিক্ষকদের দ্বিতীয় দফা আন্দোলন। এর আগে ৫ মে থেকে ২৫ মে পর্যন্ত ধাপে ধাপে কর্মবিরতি পালন করেন তারা—প্রথমে এক ঘণ্টা, পরে দুই ঘণ্টা, তারপর আধাবেলা।
২৬ মে থেকে তারা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে যান, যা চারদিন পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার–এর আশ্বাসে স্থগিত করেন।
তবে সেই আশ্বাস বাস্তবায়িত না হওয়ায় শিক্ষকরা আবারও রাস্তায় নেমেছেন।
পরিষদের নেতা আবুল কাশেম বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে সহকারী শিক্ষকরা দশম গ্রেডের দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু সরকার বারবার তা অগ্রাহ্য করেছে। আমরা পরে ১১তম গ্রেডে নামি, কিন্তু তাও বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে আমরা আন্দোলনে নেমেছি।”
বিশেষজ্ঞদের মত ও সরকারি অবস্থান
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার মনে করেন, সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেডের দাবি যৌক্তিক নয়।
তিনি বলেন, “প্রধান শিক্ষকদের সম্প্রতি দশম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। সহকারী শিক্ষকদের সংখ্যা অনেক বেশি, তাই একবারে ১৩ থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা বাস্তবসম্মত নয়। তবে আমরা তাদের ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার জন্য কাজ করছি।”
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবু নূর মো. শামসুজ্জামান বলেন, “আমরা সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডের জন্য সুপারিশ করেছি। এটি অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে তারা তা পাবে। তবে এর বাইরে আমাদের কিছু করার নেই।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “বার্ষিক পরীক্ষার আগে এ কর্মবিরতিতে শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। আগে থেকেই শিখন ঘাটতি ছিল, এখন তা আরও বাড়বে। এটি সত্যিই উদ্বেগজনক।”