১০ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৯শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

ট্রাম্পের ভাষণ বিকৃতির অভিযোগে বিবিসির মহাপরিচালক ও সংবাদ প্রধানের পদত্যাগ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি তথ্যচিত্র ভুলভাবে সম্পাদনার অভিযোগে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেছেন ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভি এবং সংবাদ বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডেবোরাহ টার্নেস।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ ফাঁস হওয়া একটি অভ্যন্তরীণ নথি প্রকাশ করে জানায়, বিবিসির ‘প্যানোরামা’ নামের একটি ডকুমেন্টারিতে ট্রাম্পের ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ভাষণের দুটি পৃথক অংশ সম্পাদনা করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে মনে হয় তিনি সরাসরি ক্যাপিটল হিলে সহিংসতার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর বিবিসির পক্ষপাতমূলক সম্পাদনা ও সম্পাদকীয় মানদণ্ড নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়।

রোববার (৯ নভেম্বর) সন্ধ্যায় পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে টিম ডেভি বলেন, বিবিসি নিখুঁত নয়, তবে সব সময় স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক থাকা জরুরি। সাম্প্রতিক বিতর্কের দায় স্বীকার করে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে সব ভুলের চূড়ান্ত দায় তারই। অন্যদিকে ডেবোরাহ টার্নেস জানান, প্যানোরামা বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তা বিবিসির সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে। তিনি বলেন, জনজীবনের নেতাদের জবাবদিহি থাকা উচিত, তাই তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যদিও ‘বিবিসি নিউজকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট’ বলা মিথ্যা দাবি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

টেলিগ্রাফের প্রকাশিত নথিতে বিবিসি আরবি বিভাগের ইসরায়েল–গাজা যুদ্ধসংক্রান্ত প্রতিবেদনে পদ্ধতিগত পক্ষপাতের অভিযোগও তোলা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্পের মূল ভাষণে তিনি বলেন, “আমরা ক্যাপিটলে যাব এবং সাহসী সিনেটরদের উৎসাহ দেব,” কিন্তু প্যানোরামার সম্পাদিত সংস্করণে দেখানো হয়, “আমরা ক্যাপিটলে যাব… আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব। আমরা লড়ব, জোরে লড়ব।” এই দুই বক্তব্য মূল বক্তৃতায় ৫০ মিনিটেরও বেশি ব্যবধানে ছিল।

হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিবিসিকে “সম্পূর্ণ ভুয়া সংবাদমাধ্যম” আখ্যা দেয়। রোববার এক বিবৃতিতে ট্রাম্প বলেন, বিবিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা ধরা পড়েছেন তার “নিখুঁত ভাষণ বিকৃত করতে গিয়ে”, এবং পদত্যাগ ছিল “ন্যায়সংগত ও প্রাপ্য পরিণতি”। বিবিসির চেয়ারম্যান সামির শাহ বলেন, এটি প্রতিষ্ঠানের জন্য দুঃখজনক দিন। তিনি জানান, টিম ডেভি দীর্ঘদিন দায়িত্বশীলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তবে ব্যক্তিগত ও পেশাগত চাপে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

নথির লেখক মাইকেল প্রেস্কট, বিবিসির সম্পাদকীয় মান যাচাই কমিটির সাবেক উপদেষ্টা, তার প্রতিবেদনে বিবিসির ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতেও পক্ষপাতের অভিযোগ আনেন। এছাড়া বিবিসি সম্প্রতি নিরপেক্ষতা সংক্রান্ত ২০টি অভিযোগ স্বীকার করেছে, যার মধ্যে রয়েছে সংবাদ উপস্থাপক মার্টিন ক্রক্সালের সরাসরি সম্প্রচারে স্ক্রিপ্ট পরিবর্তন, গাজা নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারিতে হামাস কর্মকর্তার ছেলের সম্পৃক্ততা গোপন রাখা এবং গ্লাস্টনবেরি উৎসবে ‘ডেথ টু আইডিএফ’ স্লোগানযুক্ত গান প্রচার করা।

বিবিসির সাবেক নিউজ প্রধান রজার মোসি বলেন, ট্রাম্পের ভাষণ সম্পাদনা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং বিবিসি বিষয়টি মোকাবেলায় দেরি করেছে। চ্যানেল ৪–এর সাবেক নিউজ প্রধান ডরোথি বাইর্নও একে “মৌলিক ভুল” আখ্যা দিয়ে বলেন, বিবিসি ক্ষমা চাইতে দেরি করেছে। টিম ডেভি, যিনি ২০ বছর ধরে বিবিসিতে কর্মরত ছিলেন, জানিয়েছেন, তার পদত্যাগের সময় এমনভাবে নির্ধারিত হবে যাতে নতুন মহাপরিচালক পরবর্তী রয়্যাল চার্টার প্রণয়নের আগে সংগঠনটিকে পুনর্গঠনের সুযোগ পান।

ব্রিটিশ সংস্কৃতি সচিব লিসা ন্যান্ডি বলেছেন, বিবিসি যুক্তরাজ্যের জাতীয় জীবনের অপরিহার্য অংশ এবং টিম ডেভি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কনজারভেটিভ নেতা কেমি বাডেনোক পদত্যাগকে যথাযথ পদক্ষেপ উল্লেখ করে বলেন, “বিবিসির পক্ষপাত ও ব্যর্থতা সংস্কার না হলে জনগণকে বাধ্যতামূলক লাইসেন্স ফি দিতে বলা অন্যায়।”

অন্যদিকে লিবারেল ডেমোক্র্যাট নেতা স্যার এড ডেভি মনে করেন, এটি বিবিসির জন্য নতুন অধ্যায় শুরু করার সুযোগ। রিফর্ম ইউকের নেতা নাইজেল ফারাজ বলেন, এখনই সময় বিবিসিকে ভেতর থেকে বদলে ফেলার। এদিকে বিবিসি বোর্ডের দায়িত্ব এখন নতুন মহাপরিচালক নিয়োগের। যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম অঙ্গনে এখন প্রশ্ন একটাই—কে এই সংকটকালে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমের নেতৃত্ব নেবেন।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top