মিজানুর রহমান:
মানুষ সামাজিক জীব। হাসি, গল্প, আলাপ আর আড্ডা, এই জিনিসগুলো আমাদের জীবনের এক অনন্য অংশ। এগুলোর মাধ্যমেই গড়ে ওঠে পারস্পরিক সম্পর্ক, জন্ম নেয় বন্ধুত্ব, তৈরি হয় সহানুভূতি ও আনন্দ। কিন্তু এই হাসি-আনন্দের মাঝেই কখনও কখনও এমন কিছু কথা আমরা বলে ফেলি যা পুরোপুরি সত্য নয়। কখনও মজা করার ছলে, কখনও পরিবেশটা হালকা রাখতে, আবার কখনও অন্যকে হাসানোর উদ্দেশ্যে আমরা বলে ফেলি একেকটি “সাদা মিথ্যা।”
বেশিরভাগ মানুষ মনে করে—“আরে, এতে ক্ষতি কী! হাসির জন্যই তো বলেছি।” কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে মিথ্যা কোনোভাবেই তুচ্ছ নয়। মিথ্যা ছোট বা বড় বলে কিছু নেই; প্রতিটি মিথ্যাই আল্লাহর কাছে গুনাহ। আর এই মিথ্যা যখন হাসির আবরণে লুকিয়ে আসে, তখন সেটি আরও সূক্ষ্ম, আরও বিপজ্জনক এক পাপরূপে দেখা দেয়।
কোরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে মিথ্যার ভয়াবহতা: মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ মিথ্যাবাদী ও অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে পথ দেখান না।” (সূরা আয-যুমার:৩) আরও বলেন,“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থেকো।” (সূরা আত-তাওবা: ১১৯)এই আয়াতগুলো স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে মিথ্যা শুধু একটি খারাপ অভ্যাস নয়, বরং এটি মানুষের ঈমান ও চরিত্রকে ধ্বংস করে দেয়।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,“মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়, আর পাপ নিয়ে যায় জাহান্নামের দিকে।” (সহিহ বুখারী ও মুসলিম) আরেক হাদীসে তিনি বলেন,“মুমিন হতে পারে কাপুরুষ, হতে পারে কৃপণ; কিন্তু মিথ্যাবাদী কখনো মুমিন হতে পারে না।” (মুসনাদ আহমাদ) এগুলো শুধু ধর্মীয় বিধান নয়, এগুলোর মধ্যে রয়েছে মানুষের নৈতিক ও মানসিক পরিশুদ্ধির শিক্ষা। কারণ, মিথ্যা বলা একবার অভ্যাসে পরিণত হলে সত্য বলার শক্তি হারিয়ে যায়। তখন মানুষ নিজেকেই প্রতারণা করতে শুরু করে।
“সাদা মিথ্যা” কি আদৌ নির্দোষ?: আমরা প্রায়ই বলি “আমি তো কারও ক্ষতি করিনি, শুধু মজা করেই বলেছি।” কিন্তু ইসলামে এমন কোনো মিথ্যা নেই যা “নির্দোষ” হিসেবে গণ্য হবে। হাসির ছলে বলা মিথ্যা, অতিরঞ্জন, বা বানানো গল্প—সবই সত্য বিকৃতির অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“মানুষের মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না, যে কথা লিখে রাখার জন্য একজন পাহারাদার উপস্থিত থাকে না।” (সূরা ক্বাফ: ১৮) অর্থাৎ, প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ নথিবদ্ধ হচ্ছে। এমনকি মজার ছলে বলা কথাও হিসাবের বাইরে নয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করে বলেছেন,“একজন মানুষ মজা করতে গিয়েও মিথ্যা বলে, কিন্তু সে বুঝে না যে, সেই কথার জন্য সে জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হতে পারে।” (সহিহ বুখারী) অতএব, মিথ্যা হাসির মাধ্যমেও হতে পারে বড় গুনাহ। কারণ এটি ধীরে ধীরে মানুষকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
দৈনন্দিন জীবনে মিথ্যার রূপ: আমরা যদি চারপাশে তাকাই, দেখতে পাবো মিথ্যা এখন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। অফিসে কেউ বলে,“সারাদিন কাজ করেছি”, অথচ বেশিরভাগ সময় নষ্ট হয়েছে আড্ডায়। বন্ধুদের আড্ডায় গল্প জমাতে কেউ বলে—“এই ঘটনাটা আমি নিজে দেখেছি!”পরিবারে কেউ রাগ এড়াতে মিথ্যা অজুহাত দেয়—“ট্রাফিকের জন্য দেরি হয়েছে।”সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণে বানিয়ে ফেলে চমকপ্রদ গল্প। সব ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য ক্ষুদ্র,কিন্তু পরিণতি ভয়াবহ। কারণ মিথ্যা একবার মুখে এলে আত্মা কলুষিত হয়, বিবেক দুর্বল হয়, সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে যায়।
মিথ্যার সামাজিক প্রভাব: মিথ্যা শুধু ব্যক্তিগত চরিত্র নষ্ট করে না; এটি সমাজের ভিতও দুর্বল করে। যেখানে মিথ্যা প্রচলিত হয়, সেখানে বিশ্বাস হারিয়ে যায়, সম্পর্কের জায়গায় আসে সন্দেহ। একসময় পরিবার, প্রতিষ্ঠান, এমনকি রাষ্ট্রব্যবস্থাও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। ইসলাম তাই সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। সত্যবাদিতা শুধু ব্যক্তিগত গুণ নয়, এটি সামাজিক শান্তির মূল ভিত্তি।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,“যে ব্যক্তি আমাকে নিশ্চয়তা দেবে তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থান রক্ষা করবে, আমি তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব।” (সহিহ বুখারী)অর্থাৎ, মুখের নিয়ন্ত্রণ—সত্য কথা বলা—জান্নাত লাভের অন্যতম শর্ত।
সত্যের সৌন্দর্য ও আল্লাহর সন্তুষ্টি: সত্য বলা সবসময় সহজ নয়। অনেক সময় সত্য কথা কারও মন খারাপ করতে পারে, আবার কখনও নিজেকেই সমস্যায় ফেলতে পারে। কিন্তু সত্যের মধ্যে রয়েছে প্রশান্তি ও আত্মবিশ্বাস। একজন সত্যবাদী মানুষ কখনও ভয় বা অপরাধবোধে ভোগে না। তার অন্তরে থাকে দৃঢ়তা ও শান্তি। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম উপায় হলো সততা। সত্যবাদী ব্যক্তি আল্লাহর কাছে প্রিয়, মানুষের কাছেও বিশ্বস্ত। তার কথায় বরকত থাকে, তার জীবনে আল্লাহর রহমত নেমে আসে।
মনস্তত্ত্ব ও নৈতিকতার দৃষ্টিতে: মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা যায়, যে মানুষ নিয়মিত মিথ্যা বলে, তার মানসিক চাপ ও অপরাধবোধ বেড়ে যায়। এমন মানুষ ধীরে ধীরে নিজের পরিচয় ও আত্মসম্মান হারিয়ে ফেলে। সে জানে, তার কথা মানুষ বিশ্বাস করে না,ফলে একধরনের অস্থিরতা ও হতাশা কাজ করে।
অন্যদিকে, সত্যবাদী মানুষ মানসিকভাবে দৃঢ় থাকে। তার জীবনে স্বচ্ছতা ও আত্মবিশ্বাস জন্মায়। সে জানে, যা বলছে তা সত্য, তাই কোনো অপরাধবোধ নেই। এই প্রশান্তিই আল্লাহপ্রদত্ত বরকত।
আধুনিক যুগে মিথ্যার নতুন চেহারা: ডিজিটাল যুগে মিথ্যার রূপ আরও জটিল হয়েছে। এখন মিথ্যা শুধু মুখে নয়—পোস্ট, ছবি, ভিডিও, এমনকি “স্ট্যাটাস”-এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ ভুয়া ছবি শেয়ার করে, কেউ অন্যের পরিচয় নিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে। কেউ আবার রাজনৈতিক বা সামাজিক স্বার্থে গুজব ছড়ায়। এগুলো সবই মিথ্যার আধুনিক রূপ। ইসলামে গুজব রটানোও বড় গুনাহ। আল্লাহ বলেন,“যখন তোমরা মিথ্যা সংবাদ শুনে তা মুখে মুখে প্রচার করো, অথচ তোমরা জানো না তা সত্য কিনা—তখন তোমরা এক বড় গুনাহ কর।” (সূরা আন-নূর: ১৫) অতএব, সোশ্যাল মিডিয়াতেও সত্য যাচাই না করে কিছু বলা বা শেয়ার করা মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত।
সত্য বলার অভ্যাস গড়ে তোলা: সত্যবাদিতা জন্মগত নয়; এটি অভ্যাসের ফসল। একজন মানুষ চাইলেই ধীরে ধীরে এই গুণ অর্জন করতে পারে। ছোট ছোট বিষয়েও সত্য বলা শুরু করা, যেমন: দেরি হলে সঠিক কারণ বলা। অতিরঞ্জন পরিহার করা—গল্প বা প্রশংসা করার সময় বাড়িয়ে না বলা। হাসির মধ্যেও সীমা রক্ষা করা—যাতে কথায় মিথ্যা না আসে। প্রতিদিন রাতে নিজের কাজ পর্যালোচনা করা—আজ আমি কি কোনো মিথ্যা বলেছি? আল্লাহর কাছে নিয়মিত দোয়া করা—তিনি যেন আমাদের মুখকে সত্যের পথে রাখেন। এই ছোট ছোট অভ্যাস একসময় সত্যবাদিতাকে চরিত্রে পরিণত করে।
হাসি হোক পবিত্র, মিথ্যা নয়: হাসি কোনো পাপ নয়। বরং হাসি ও রসবোধ মানবজীবনকে সুন্দর করে তোলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও হাসতেন, কিন্তু কখনও মিথ্যা দিয়ে নয়। তিনি বলেছেন, “তোমার ভাইয়ের মুখে হাসি ফোটানোও এক প্রকার সাদকা।” (তিরমিযী)অর্থাৎ, হাসি ইবাদতের অংশ হতে পারে, যদি তা সত্য ও পবিত্র হয়। কিন্তু মিথ্যা দিয়ে হাসি ফোটানো—তা শয়তানের খুশির কারণ। তাই আমাদের হাসি যেন হয় সত্যের সৌরভে ভরা, আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক।
জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। আমরা প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের সঙ্গে কথা বলি, হাসি, মজা করি। কিন্তু মনে রাখতে হবে—আমাদের প্রতিটি শব্দের জন্য হিসাব দিতে হবে। দুনিয়ার সামান্য হাসির জন্য যদি আমরা চিরস্থায়ী পরকালের শান্তি হারাই, তবে তার চেয়ে বড় ক্ষতি আর কিছুই হতে পারে না।
তাই চলুন, আজ থেকেই আমরা নিজেদের মধ্যে এক দৃঢ় অঙ্গীকার গড়ে তুলি—👉 হাসির মাঝেও সত্য বলবো,👉 গল্পেও সততার সৌরভ ছড়াবো,👉 আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মুখকে রাখবো মিথ্যার কলুষতা থেকে মুক্ত।
কারণ সত্য মানুষকে আল্লাহর নিকটে নিয়ে যায়, আর মিথ্যা তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। সত্যের চর্চা যদি সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ে, তবে অন্যায়, প্রতারণা ও অনাস্থা নিজে থেকেই বিলীন হয়ে যাবে।
অতএব,আমরা সবাই মহান আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা করি—হে পরম করুণাময় ক্ষমাশীল, আমাদের জিহ্বাকে মিথ্যা থেকে হেফাজত করুন। আমাদের অন্তরে সত্য ও সততার ভালোবাসা দিন। হাসির মাঝেও যেন আমরা সত্য কথা বলতে পারি এবং আপনার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। আল্লাহুম্মা আমিন।
-ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক