৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৪ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বেগম খালেদা জিয়া: আপষহীনতা, ত্যাগ ও অনন্য নেতৃত্বের এক মহত্‍ মানবিক অধ্যায়: প্রফেসর ড. কাজী রফিকুল ইসলাম

জাকির হোসেন হাওলাদার, দুমকী ও পবিপ্রবি প্রতিনিধি:

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাদের জীবনের পথচলা কেবল একটি দলের ইতিহাস নয়—একটি জাতির আত্মমর্যাদা, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, স্বাধীনতার চেতনা এবং মানুষের অধিকারের প্রতীক হয়ে ওঠে। তাঁদের পথচলার প্রতিটি বাঁকে ঝরে পড়ে জাতীয় জীবনের আবেগ, সংগ্রাম, ত্যাগ ও প্রত্যাশার রূপকথা।

বিএনপি চেয়ারপারসন, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী এবং বাংলাদেশের প্রথম ফার্স্ট লেডি বেগম খালেদা জিয়া সেইসব বিরল ব্যক্তিত্বের একজন—যাঁকে শুধু রাজনৈতিক পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না।

তিনি বাংলাদেশের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার এক জীবন্ত দলিল, এক অদম্য নারী, যিনি প্রতিকূলতার পাহাড় ভেদ করে জনগণের হৃদয়ে ‘আপষহীন নেত্রী’ হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। আজ সেই নেত্রী গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের সিসিইউতে শায়িত। মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে তাঁর বহু কষ্টসাধ্য জীবনের প্রতিটি শ্বাস। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি আমার যে শ্রদ্ধা এবং আবেগ—তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।

আমার কাছে তিনি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা নন, তিনি মায়ের মতো এক আপন মানুষ—যার সুস্থতার জন্য এখন দেশ-বিদেশের কোটি মানুষের বুক ভরা প্রার্থনা, অশ্রু এবং আর্তি।এক নারী, এক ইতিহাস : বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনকে যদি একটি নদীর স্রোতের সাথে তুলনা করি, তবে বলবো—এই স্রোত কখনো শান্ত ছিল না।

প্রবল প্রতিকূলতার ঢেউ তাকে আঘাত করেছে বারবার। শহীদ জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তিনি যখন রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর সামনে ছিল পুরুষ-প্রধান রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, ছিল অস্থিরতা, সামরিক প্রভাব, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা। কিন্তু অসাধারণ ধৈর্য, সাহস এবং দূরদর্শিতায় তিনি বিএনপিকে সংগঠিত করেন, শক্তিশালী করেন, এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তাঁর তিনবারের প্রধানমন্ত্রীত্ব শুধু প্রশাসনিক দক্ষতার গল্প নয়; এটি একটি নারীর সংগ্রামী যাত্রা—যিনি একদিন সংসারে আবদ্ধ ছিলেন, আবার পরদিন পুরো জাতির আস্থার কেন্দ্রে পরিণত হন।গণতন্ত্রের জন্য আপষহীন সংগ্রামের শক্ত প্রতীক : বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিধানে ‘আপষহীন’ শব্দটি আজ বেগম জিয়ার প্রতিশব্দ।

কারণ, তিনি যখনই ক্ষমতায় ছিলেন, মানসিক দৃঢ়তা, নীতিগত অবস্থান এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে তিনি কোন আপষ করেননি। আর ক্ষমতার বাইরে থেকেও তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল একই রকম দৃঢ়। বিশেষ করে গত দেড় দশক ধরে একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

তিনি বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, গৃহবন্দি থেকেছেন, রাজনৈতিকভাবে নিপীড়িত হয়েছেন, এমনকি ভয়াবহ অসুস্থতা নিয়েও বছরের পর বছর কারাগারে ছিলেন। কিন্তু তিনি ভাঙেননি। নতি স্বীকার করেননি। আপষ করেননি। এই দৃঢ়তা তাঁকে আজ ‘জাতির অভিভাবক’–এর আসনে বসিয়েছে—যা ক্ষমতার চেয়েও অনেক বড়।জেল, নিপীড়ন ও ষড়যন্ত্র—যা তাঁর জীবন সংকটে ফেলেছিল : ২০১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত টানা দুই বছর তিনি কারাগারে ছিলেন, এমন অবস্থায় যা কোনো মানুষ—বিশেষ করে তাঁর বয়সে—সহ্য করা অসম্ভব।পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাননি, বিষ মেশানোর ভয় ছিল সবসময়, উন্নত চিকিৎসার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।

তাঁর অসুখগুলো ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছায়। আজ তিনি যে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—তার নেপথ্যে রয়েছে সেই কঠিন কারাজীবনের নির্মম প্রভাব। তাঁর লিভার, কিডনি, ফুসফুস, আর্থ্রাইটিসসহ জটিল রোগগুলো আরও বেড়ে যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি—এই কষ্টগুলো তিনি নিজের জন্য নয়;এই জাতির গণতন্ত্রের জন্য সহ্য করেছেন। এটাই তাঁকে আমাদের কাছে মায়ের মতো মহৎ করে তোলে।

হাসপাতালে দীর্ঘ লড়াই এবং লন্ডনে নেয়ার প্রস্তুতি : ২৩ নভেম্বর থেকে তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি। ফুসফুসে ভয়াবহ সংক্রমণ, হার্টের জটিলতা এবং পুরোনো রোগগুলোর অবনতি তাঁকে এক সংকটজনক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। দেশি–বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড দিন-রাত তাঁর চিকিৎসা করছেন।

যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা চিকিৎসক রিচার্ড বিয়েল ইতোমধ্যেই ঢাকায় পৌঁছেছেন তাঁকে পর্যবেক্ষণে। কাতার সরকারের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে মধ্যরাতের পরে বা আগামী ভোরে তাঁকে লন্ডনে নেওয়া হবে। এ এক জীবন-মৃত্যুর লড়াই, যেখানে দেশের মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। হাসপাতালের সামনে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ—গ্রাম থেকে শহর, তরুণ থেকে বৃদ্ধ—এসে দাঁড়াচ্ছেন শুধু তাঁর জন্য। এটাই প্রমাণ করে—তিনি একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন, তিনি জাতির আস্থার শেষ আশ্রয়।

তারেক রহমানের অশ্রুভেজা হৃদয়—এক সন্তানের ব্যথা : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারেক রহমানের পোস্টটি আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, “মায়ের স্নেহ স্পর্শ পাবার তীব্র আকাঙ্খা যে কোনো সন্তানের মতো আমারও রয়েছে… কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার সুযোগ আমার একার নিয়ন্ত্রণে নেই।” একজন সন্তানের এর চেয়ে বেদনাদায়ক অভিঘাত আর কী হতে পারে!

মা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, অথচ তিনি পাশে যেতে পারছেন না রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে। এই ব্যথা বোঝার মতো হৃদয় এ দেশের মানুষের আছে, তাই আজ তারেক রহমানকে নিয়ে অযথা বিতর্ক নয়—সহানুভূতির ঢেউ বইছে সর্বত্র।জাতীয় ঐক্যের অনন্য দৃশ্য: দলমত নির্বিশেষে দোয়া : এ দেশের রাজনীতিতে ভিন্নমতের বিভাজন কত গভীর—তা আমরা জানি। কিন্তু আজ সেই বিভক্তির দেয়াল ভেঙে মানুষ এক হয়েছি খালেদা জিয়ার সুস্থতার প্রার্থনায়। গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকী। এনসিপির হাসনাত আবদুল্লাহ। বিশিষ্ট টকশো বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান। বিদেশে অবস্থানরত কূটনীতিকরা। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতারা। সাধারণ মানুষ—বাড়িতে, মসজিদে, রাস্তায়, সোশ্যাল মিডিয়ায়। সবাই এক কণ্ঠে প্রার্থনা করছে—“মা, আপনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন।” এ দৃশ্যই প্রমাণ করে—তিনি কেবল দলের চেয়ারপারসন নন; তিনি জাতির অভিভাবক, এক নীরব শক্তি, যাঁর উপস্থিতি দেশকে স্থিতি ও সমঝোতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

খালেদা জিয়ার জীবনে ত্যাগ—এক অমর শিক্ষা : যে নারী তিনবার প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছেন, যিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন দক্ষতার সাথে, তিনি চাইলে জীবনের শেষভাগটা সন্তান–স্বজনদের সঙ্গে কাটাতে পারতেন। চাইলে বিদেশে সুস্থ, নিরাপদ, সম্মানজনক জীবনে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বেছে নিয়েছিলেন—কষ্ট, সংগ্রাম, জনগণের পাশে দাঁড়ানো, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব, এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে অটল অবস্থান। এই ত্যাগই তাঁর জীবনকে মহিমান্বিত করেছে। আজকের সংকট—এক জাতির প্রার্থনার মুহূর্ত : আজ বেগম জিয়া শয্যাশায়ী।

মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে তাঁর ক্ষয়ে যাওয়া শরীর। কিন্তু তাঁর মন, তাঁর আত্মা, তাঁর অদম্য শক্তি—এখনো জাতির জন্য আশার আলো। আজ আমি, একজন শিক্ষক, একজন উপাচার্য, একজন নাগরিক—ব্যক্তিগতভাবে গভীর আবেগ নিয়ে এই কথাটি বলতে চাই—বেগম জিয়া আমার কাছে মায়ের মতো। তাঁর জীবন, তাঁর সাহস, তাঁর সংগ্রাম আমাকে অনুপ্রাণিত করে প্রতিনিয়ত। আজ কোটি মানুষের মতো আমিও কাঁদছি, প্রার্থনা করছি—তিনি সুস্থ হয়ে আবার ফিরে আসবেন।দেশ-বিদেশের কাছে বিনীত আবেদন: তাঁর জন্য দোয়া করুন, আজ যেসব রাজনীতিবিদ, যেসব বিরোধী মতের মানুষ, যেসব তরুণ তাঁর বিরুদ্ধে সময়ের আবেগে কঠোর কথা বলেছেন—সেসব বিতর্ক, ভুল বোঝাবুঝি সব আজ তুচ্ছ হয়ে গেছে। কারণ— তিনি একজন মানবমহিয়সী নারী। তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ইতিহাস।

তার সুস্থতা জাতির ভবিষ্যতের সাথে জড়িয়ে আছে। আমি দেশবাসীর কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করছি— আপনার নামাজে, আপনার তসবিহে। আপনার সন্তানদের দো’আয়, আপনার ঘরের আঙিনায়, আপনার ঈমানের গভীরতা থেকে। এই অসাধারণ নেত্রীটির জন্য দোয়া করবেন। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিও আহ্বান জানাই—মানবিকতার ভিত্তিতে তাঁকে সব ধরনের সহযোগিতা দিন। তিনি সুস্থ হলে বাংলাদেশ স্থিতিশীলতা, সমঝোতা ও গণতন্ত্রের পথে আরও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাবে।

পরিশেষে: একটি জাতির হৃদয় তাঁর সঙ্গে আজ আমরা সবাই অপেক্ষায়—একটি বিমান রাতের আকাশে উড়াল দেবে, সেটিতে থাকবে এই জাতির আশার প্রতীক, বেগম খালেদা জিয়া। সামনে দীর্ঘ চিকিৎসার পথ, সামনে অনিশ্চয়তা, ভয়, দুঃখ, আশা—সবকিছু মিলেমিশে এক আবেগমথিত সময়। কিন্তু আমার বিশ্বাস—যে নারী এত প্রতিকূলতা জয় করেছেন,তিনি এই লড়াইও জিতবেন। তিনি সুস্থ হয়ে ফিরবেন—জনগণের ভালোবাসায়, সন্তানের প্রার্থনায়, এ দেশের গণতন্ত্রের আহ্বানে, এবং কোটি মানুষের দোয়ায়। মহান আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁকে রহমত, আরোগ্য ও সুস্থতা দান করেন। আমিন।।#

প্রফেসর ড. কাজী রফিকুল ইসলাম
উপাচার্য
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top