১২ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বিদ্যুৎ খাতে ৫৫ হাজার কোটি টাকার লোকসান, ভর্তুকি ৩৮ হাজার কোটি

নিজস্ব প্রতিনিধি:

বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করার কারণে গত অর্থবছরে সরকার বিদ্যুৎ খাতে ৫৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এর মধ্যে ৩৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, আর অবশিষ্ট ১৭ হাজার কোটি টাকার লোকসান এখন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) উপর চাপ হিসেবে রয়েছে। আগের বছরও এই খাতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছিল।

গত বুধবার পিডিবির বোর্ড সভায় বিদ্যুৎ খাতের আয়-ব্যয়ের হিসাব অনুমোদনের পর এই বড় ঘাটতির চিত্র উঠে আসে। তবে পিডিবির সদস্য (অর্থ) অঞ্জনা খান মজলিস জানান, সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার আগে তারা বিস্তারিত জানাতে চান না।

বিদ্যুৎ খাতে লোকসানের বড় কারণ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর (আইপিপি) ক্যাপাসিটি চার্জ—যার পেছনেই কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব চুক্তি পর্যালোচনায় গঠিত জাতীয় কমিটি গত মাসে জানায়, বিগত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ খাতে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে। পিডিবি জানায়, গত অর্থবছরে বিদ্যুতের দাম না বাড়লেও উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যয় ব্যাপক বেড়েছে। বিশেষত গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় ফার্নেস অয়েল ও কয়লাচালিত বিদ্যুৎ বেশি কিনতে হয়েছে, যা উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়েছে।

সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রায় ১০ টাকা ৮০ পয়সা, আর বিতরণ কোম্পানির কাছে সরবরাহ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১২ টাকা ৫০ পয়সা। অন্যদিকে প্রতি ইউনিট বিক্রি করা হয়েছে ৬ টাকা ৯৯ পয়সা দরে। এই বিশাল ফারাক থেকেই পিডিবির মোট ৫৫ হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে।

আইপিপি এবং রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকেই সরকারের সর্বাধিক ব্যয়। কারণ, তাদের উৎপাদিত উচ্চমূল্যের বিদ্যুতের লোকসান পুরোপুরি ভর্তুকি দিয়ে পুষিয়ে দিচ্ছে সরকার। গত বছর এ হিসেবে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের বাড়তি খরচের জন্য কোনো ভর্তুকি দেওয়া হয়নি।

পিডিবি জানায়, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিট খরচ ৭ টাকা, কয়লাভিত্তিকে ১৩ টাকা, ফার্নেস অয়েলে ২২ টাকা, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতে ৮ টাকা এবং ডিজেলে ৪০ টাকার বেশি। ডিজেলকেন্দ্র এখন প্রায় বন্ধ, কেবল জরুরি প্রয়োজনে কিছু জেনারেটর ব্যবহার হয়।

দেশে বর্তমানে ১৩৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট, যার মধ্যে ৭০টি আইপিপি কেন্দ্র উৎপাদন করছে ১১ হাজার মেগাওয়াট। কয়লাভিত্তিক ৮টি কেন্দ্র এখন তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য—মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াট।

গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪৮.৫২% এসেছে গ্যাস থেকে, ১১.৮৩% ফার্নেস অয়েল থেকে, ৯% সৌর থেকে, এবং ০.৮৬% জলবিদ্যুৎ থেকে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদ্যুৎ খাতে এখনো অরাজকতা বিদ্যমান এবং এ খাত এখনো শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।

এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব চুক্তি পর্যালোচনায় গঠিত জাতীয় কমিটি গত মাসে জানায়, পূর্বের সরকারের সময়ে বেসরকারি কেন্দ্রের মালিক, আমলা ও রাজনীতিবিদদের যোগসাজশে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, যার কারণে গ্রাহকদের ২৫% বেশি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top