তাহাজ্জুদ নামাজ ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ একটি ইবাদত। এই নামাজ রাতের শেষ প্রহরে আদায় করা হয় এবং এটি একান্তে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার একটি বিশেষ সুযোগ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাহাজ্জুদ নামাজকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন এবং তাঁর উম্মতদেরও এই নামাজ আদায় করতে উৎসাহিত করতেন। এই নামাজ আদায়ের সঠিক নিয়ম, নিয়ত এবং দোয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। এই নামাজের মাধ্যমে মুমিন বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে এবং আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়। কুরআনুল কারিমের বিভিন্ন আয়াতে এবং হাদিসে তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন:
“আর রাতের কিছু অংশে (নফল ইবাদত হিসেবে) তাহাজ্জুদ আদায় করো; এটা তোমার জন্য অতিরিক্ত ইবাদত। সম্ভবত তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।”
(সূরা আল-ইসরাঃ ৭৯)
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা আরেক আয়াতে বলেছেন:
“তোমার প্রভু নিশ্চয়ই জানেন যে, তুমি এবং তোমার সাথে যারা আছে তারা দুই-তৃতীয়াংশ রাতের কম, অর্ধেক, কিংবা এক-তৃতীয়াংশ সময় রাত জেগে ইবাদত কর। আল্লাহ রাত ও দিনের মাপ নির্ধারণ করেন। তিনি জানেন যে, তোমরা তা হিসাব করে নির্ধারণ করতে পারবে না। সুতরাং তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।”
(সূরা আল-মুজাম্মিলঃ ২০)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
“তোমরা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ো। এটি তোমাদের পূর্ববর্তী নেককারদের প্রথা, এবং এটি আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য নৈকট্য লাভের মাধ্যম, পাপের জন্য ক্ষমা এবং পাপ থেকে বিরত থাকার মাধ্যম।”
(তিরমিযী: ৩৫৪৯)
অন্য আরেক হাদিসে বলেছেন
“রাতের নামাজ (তাহাজ্জুদ) মুমিনের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়। আল্লাহ তায়ালা এই নামাজের মাধ্যমে বান্দার দোয়া কবুল করেন এবং বান্দার গুনাহ মাফ করেন।”
(মুসলিম: ৭৫৭)
তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর কাছে একান্তে প্রার্থনা করতে পারে এবং তার সমস্ত প্রয়োজন ও কষ্টের কথা জানাতে পারে। এটি একটি আত্মার পরিশুদ্ধি এবং ঈমানের দৃঢ়তার মাধ্যমে আত্মার উন্নতি সাধন করে। তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়, যা মুমিনের জীবনে শান্তি ও বরকত নিয়ে আসে।
তাহাজ্জুদ নামাজ সেই নামাজ, যা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বদা আদায় করতেন এবং এটি তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। তিনি তাঁর উম্মতদেরও এই নামাজ আদায়ের জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন, কারণ এটি আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় ইবাদত এবং এতে বান্দার জন্য অসীম সওয়াব রয়েছে।
তাহাজ্জুদ নামাজের সঠিক নিয়ম
তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম অনুসরণ করা উচিত:
- নিয়ত: তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত করতে হবে, যা অন্তরের ইচ্ছার সাথে সম্পন্ন হয়। কোনো নির্দিষ্ট বাক্য বলা বাধ্যতামূলক নয়, তবে নিয়ত করতে হবে যে আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করছেন।
- রাকাত সংখ্যা: তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য নির্দিষ্ট কোনো রাকাত সংখ্যা নেই। এটি ২ রাকাত থেকে শুরু করে ৮, ১০ বা ১২ রাকাত পর্যন্ত আদায় করা যেতে পারে। তবে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাধারণত ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন।
- সুরা পঠিত করা: প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর কুরআনের অন্য কোনো সূরা বা আয়াত পঠন করতে হবে। আপনি নিজের পছন্দ অনুযায়ী সুরা পড়তে পারেন।
- দোয়া: তাহাজ্জুদ নামাজ শেষ করে আল্লাহর কাছে দীর্ঘ সময় ধরে দোয়া করুন। আল্লাহ তায়ালার কাছে নিজের এবং উম্মতের জন্য ক্ষমা, সাহায্য ও হেদায়েত প্রার্থনা করুন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দোয়া করার সময় বিশেষ কিছু দোয়া করতেন, যা আমরা অনুসরণ করতে পারি।
তাহাজ্জুদ নামাজের সময়
তাহাজ্জুদ নামাজ রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আদায় করা সর্বোত্তম। তবে কেউ যদি রাতের মাঝখানে ঘুম থেকে উঠতে না পারে, তবে রাতের প্রথম ভাগে, ইশার নামাজের পরে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা যেতে পারে। হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা রাতের শেষ প্রহরে পৃথিবীর নিকটতম আসমানে অবতীর্ণ হন এবং বলেন:
“কে আছে যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আছে যে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে তা প্রদান করব? কে আছে যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব?”
(বুখারী: ১১৪৫, মুসলিম: ৭৫৮)
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত খুবই সহজ এবং নির্দিষ্ট কোনো বাক্য নেই। অন্তরে এই নিয়ত করতে হবে যে, আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করছেন।
তাহাজ্জুদ নামাজের দোয়া
তাহাজ্জুদ নামাজের পর আল্লাহর কাছে দোয়া করার সময় আপনি নিজের ভাষায় দোয়া করতে পারেন। তবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু বিশেষ দোয়া করতেন, যা আমরা অনুসরণ করতে পারি। একটি প্রিয় দোয়া হলো:
“اللَّهُمَّ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ”
“হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করো এবং আখিরাতে কল্যাণ দান করো এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।”
(বুখারী: ৬৩৪০, মুসলিম: ২৬৯۰)
উপসংহার
তাহাজ্জুদ নামাজ একটি বিশেষ ইবাদত যা আমাদের আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় আমাদের আধ্যাত্মিক শক্তি বাড়াতে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করতে সাহায্য করে। তাই, আমরা সকলে চেষ্টা করব যেন এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতকে আমাদের জীবনের একটি অংশ করে নিতে পারি।