১০ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১২ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

রমজান, প্রেমিক ও প্রভুর মাঝে এক অপূর্ব ভালোবাসার গল্প

লেখক, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিশর

রাতের আকাশে এক ফালি চাঁদ উঁকি দেয়। পৃথিবী তখন নিস্তব্ধ, কিন্তু কিছু হৃদয় গভীর আলোড়নে কেঁপে ওঠে। এ এক বিশেষ মুহূর্ত, এক প্রেমের আমন্ত্রণ—রমজান এসেছে! যেন এক প্রিয় অতিথি, যে হৃদয়ের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে, বলছে:
“এসো, আমার সাথে এক মহাসমুদ্র ভালোবাসায় ডুব দাও। আল্লাহর নৈকট্যে নিজেকে বিলীন করো।”

প্রেমের প্রথম আহ্বান, রমজানের চাঁদ

যখন রমজানের চাঁদ ওঠে, তখন অন্তরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নামে। মনে হয়, যেন আসমান থেকে রহমতের পরশ এসে হৃদয়কে ছুঁয়ে দিল। এই চাঁদ সাক্ষী থাকে এক পবিত্র সম্পর্কের, যেখানে প্রেমিক তার প্রভুর সান্নিধ্যে নিজেকে সঁপে দেয়।
আল্লাহ বলেন:
“হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সুরা আল-বাকারা: ১৮৩)

তাকওয়া মানে কি? এটি সেই প্রেম, যেখানে বান্দা চায় তার প্রভু তাকে ভালোবাসুন, তাকে গ্রহণ করুন। সে নিজের সমস্ত ত্রুটি-অপরাধ ধুয়ে ফেলে নতুনভাবে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে চায়।

সেহরি, গভীর ভালোবাসার প্রস্তুতি

রাতের শেষ প্রহরে যখন নিস্তব্ধতা চারদিকে ছেয়ে থাকে, তখন কিছু প্রেমিক জেগে ওঠে। তারা নিদ্রা ত্যাগ করে, আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়। তাদের এক হাতে পানির গ্লাস, অন্য হাতে খেজুর, কিন্তু হৃদয় তখন অন্য এক আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
“সেহরির খাবারে বরকত রয়েছে, তাই তোমরা সেহরি খাও।” (সহিহ বুখারি: ১৯২৩)

কিন্তু এই খাবার শুধু পেট ভরানোর জন্য নয়; এটি এক ভালোবাসার সংকল্প। এটি এক প্রেমিকের প্রতিজ্ঞা—আজ সে তার প্রভুর জন্য ক্ষুধার্ত থাকবে, তার জন্য তৃষ্ণার্ত থাকবে, তার জন্য নিজেকে সংযত রাখবে।

রোজার দিন, প্রেমের পরীক্ষা, ধৈর্যের সাধনা

সূর্য যত উঁচুতে উঠে, ক্ষুধা আর তৃষ্ণা ততই প্রবল হয়। কিন্তু প্রেমিক জানে, এটি শুধু শারীরিক কষ্ট নয়, এটি আত্মার এক পরীক্ষা।
“আমি কষ্ট পাচ্ছি, কিন্তু এই কষ্ট আনন্দের, কারণ এটি আমার প্রভুর জন্য।”
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
“আল্লাহ বলেন: রোজা আমার জন্য, এবং আমি নিজে এর প্রতিদান দেব।” (সহিহ বুখারি: ১৯০৪)

একজন প্রেমিকের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত একেকটি প্রতীক্ষা। প্রেম যখন নিখাদ হয়, তখন কষ্টও মধুর হয়ে ওঠে।

ইফতার, প্রেমিক ও প্রভুর মিলনের মুহূর্ত

সূর্য অস্ত যায়, আকাশের রঙ লালচে হয়ে ওঠে, বাতাসে এক ধরণের প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। এটি সেই মুহূর্ত, যখন প্রেমিক ও প্রভুর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে।
খেজুরের প্রথম কামড়ে মনে হয়, যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কেউ তার প্রিয়জনের সান্নিধ্যে পৌঁছেছে। চোখে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ে, কারণ সে জানে—এই সামান্য জল ও খাদ্যের চেয়েও বড় কিছু সে অর্জন করেছে। সে তার প্রভুর প্রেমে আরও এক ধাপ এগিয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:

“রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে—একটি যখন সে ইফতার করে, আরেকটি যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে।” (সহিহ বুখারি: ১৯০৪)

তারাবীহ, প্রেমের গভীর আলাপন
রাত বাড়ে, মসজিদগুলো আলোকিত হয়, কোরআনের সুর বাতাসে ভাসে। প্রেমিক বান্দারা সারি বেঁধে দাঁড়ায়, দীর্ঘ সিজদায় নিজেদের বিলীন করে দেয়।

“হে আল্লাহ! আমি তোমার ভালোবাসায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাই। আমাকে তোমার কাছেই রেখে দাও!”

প্রতিটি রাকাত, প্রতিটি সিজদা যেন একেকটি ভালোবাসার চিঠি, যা বান্দা তার প্রভুর দরবারে পেশ করছে।
তাহাজ্জুদ,গভীর প্রেমের প্রার্থনা

রাতের নিস্তব্ধতায়, যখন পৃথিবী এক অগোচরে ঘুমিয়ে থাকে, তখন তাহাজ্জুদ নামাজের সময় আসে। এ সময়, একমাত্র প্রেমিকই তার প্রভুর কাছে একান্ত সময় কাটাতে আসে। এটি এমন এক রাতের প্রার্থনা, যেখানে আত্মার গভীরে প্রেমের অনুভূতি প্রবাহিত হয়।
তাহাজ্জুদ হলো এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎ, যেখানে বান্দা গভীর রাতে তার প্রভুর কাছে নিজেকে সঁপে দেয়, তার প্রেমে ডুবে যায়। এটি এক আশীর্বাদের মুহূর্ত, যেখানে বান্দা তার সর্বোচ্চ সাধনা ও প্রেমের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছায়।

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
“রাত্রে তাহাজ্জুদ আদায় করো, কারণ এটি তোমাদের ওপর ফরজ না হলেও, এটি তোমাদেরকে অত্যন্ত মর্যাদা দান করবে।” (সহিহ মুসলিম: ৭৪৫)

লাইলাতুল কদর, প্রেমের চূড়ান্ত সংযোগ

রমজানের সবচেয়ে রহস্যময় ও মহিমান্বিত রাত লাইলাতুল কদর। এ রাতে আসমান থেকে ফেরেশতারা নেমে আসে, আল্লাহর রহমতের দরজা উন্মুক্ত হয়।

আল্লাহ বলেন:
“লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ অবতরণ করেন, তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে সকল বিষয়ে। এটি শান্তি, যা ভোর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।” (সুরা আল-কদর: ৩-৫)
যে ব্যক্তি এই রাতে আল্লাহর প্রেমে ডুবে যায়, তার জন্য রয়েছে অফুরন্ত ক্ষমা, দয়া ও ভালোবাসা।

ঈদের সকাল, প্রেমের পুরস্কার

এক মাসের দীর্ঘ প্রেমের সফর শেষে আসে ঈদ। এটি শুধু খুশির দিন নয়, এটি সেই অনুভূতির দিন, যখন বান্দা নিশ্চিত হয়—তার প্রভু তাকে ক্ষমা করেছেন, তাকে গ্রহণ করেছেন।

তার হৃদয় বলে ওঠে:
“আমি চেষ্টা করেছি, আমি কেঁদেছি, আমি ভালোবেসেছি—এবং আমার প্রভুও আমাকে ভালোবেসেছেন!”

প্রেমের আসল সৌন্দর্য এখানেই। রমজান শেষ হয়ে গেলেও এই ভালোবাসা যেন শেষ না হয়। যে হৃদয় একবার আল্লাহর প্রেমে ডুবে যায়, সে আর ফিরে যেতে চায় না। সে চায় তার রবের ভালোবাসায় সারা জীবন নিমগ্ন থাকতে।
রমজান আমাদের শেখায় যে, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক কেবল আনুষ্ঠানিক ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি হৃদয়ের গভীরতম সংযোগ, যা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এই সম্পর্ক রমজানের পরেও জীবন্ত থাকা উচিত—প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি কর্মে, প্রতিটি দোয়ায়।
হে আল্লাহ! আমাদের রমজানের ভালোবাসা সারাজীবন টিকিয়ে রাখার তৌফিক দাও। আমাদের হৃদয়কে চিরকাল তোমার প্রেমে ডুবিয়ে দাও!

 

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

এই বিভাগের আরও খবর

আল্লাহর ভালোবাসা—হৃদয়ের আকাশ জুড়ে অনন্ত শান্তির প্রভা

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান যখন পৃথিবীর সমস্ত শব্দ স্তব্ধ হয়ে আসে, যখন সব আশা ধূসর ধুলোয় মিশে যায়—তখনো এক অনন্ত আশ্রয়, এক চিরন্তন ভালোবাসা

৫ মে: শাপলা চত্বরের সেই রক্তাক্ত রাতের স্মৃতি

আজ ঐতিহাসিক ৫ মে। ক্যালেন্ডারে অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও বদলায়নি সেই ‘ভয়াল রাতের স্মৃতি’। ২০১৩ সালের এই দিন, ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে ইতিহাসের ‘নির্মমতম গণহত্যা’

আবেগের কফিনে গাঁথা এক জীবনের কবরগাথা

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান সে ছিল স্বপ্নবতী এক তরুণী—চেহারায় মাধুর্য, মননে দীপ্তি। চোখে ছিল স্বপ্ন, হৃদয়ে ছিল নির্মল আকাঙ্ক্ষা। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়ার সময় একদিন স্বাভাবিকভাবেই

ঘামে লেখা গৌরবনামা ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা ও মানবতার দৃষ্টিভঙ্গি

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান সকাল যখন দিগন্তে আলো ছড়িয়ে দেয়, তখন প্রথম যে শব্দ ভেসে আসে, তা হলো হাতুড়ির শব্দ, করাতের ঘর্ষণ কিংবা জমিনে

Scroll to Top