লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
“যেখানে শরিয়াহ কাঁদে, সেখানে রাষ্ট্রের নীরবতা সবচেয়ে জোরালো ভাষ্য হয়ে ওঠে।”
সৌদি আরব—যে ভূমিতে পয়গম্বরের পা পড়েছিল, যেখানে ওহীর প্রথম ধারা ঝরে পড়েছিল মানুষের হৃদয়ে—সেই ভূমির বুকে আজ কাঁপছে ইসলামী চেতনার ভিত্তি। কঠোর শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে যে সৌদি আরব একদিন গর্ব করত, সেই রাষ্ট্র এখন আধুনিকতার মোড়কে খুলে দিচ্ছে এক এক করে সেই নিষেধের দরজাগুলো, যেগুলোর প্রহরায় ছিল কুরআনের আয়াত আর নবীর সুন্নাহ।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে রিয়াদের কূটনৈতিক এলাকায় চালু হয় এমন এক দোকান, যেখানে কেবল অমুসলিম কূটনীতিকরা লাইসেন্সের ভিত্তিতে কিনতে পারেন অ্যালকোহল। একে বলা হচ্ছে সীমিত পরিসরে একটি ‘শৃঙ্খলিত’ ব্যবস্থা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এর দ্বারা কেবল বিদেশি কূটনৈতিক আচারের ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে। তবে এটুকু বলতে দ্বিধা নেই, এমন একটি সিদ্ধান্ত অতীতের রক্ষণশীল সৌদি আরবের ক্ষেত্রে ছিল অকল্পনীয়। একসময় যেই রাষ্ট্রের বিমানবন্দরে বিদেশিদের সঙ্গে থাকা অ্যালকোহল জব্দ করে জনসমক্ষে ধ্বংস করা হতো, সেখানে আজ তার জন্য সরকারি দোকান।
এখানেই শেষ নয়। ২০২৫ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আরও বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। দাবি করা হয়, সৌদি সরকার ২০২৬ সাল থেকে পর্যটন নির্ভর অঞ্চলে নির্দিষ্ট হোটেল ও রিসোর্টে পর্যটকদের জন্য সীমিতভাবে অ্যালকোহল বিক্রির অনুমতি দিতে যাচ্ছে। যদিও সৌদি সরকার এসব প্রতিবেদনকে “ভিত্তিহীন” বলেই নাকচ করে দিয়েছে, তবুও প্রশ্নটা থেকেই যায়—যেখানে একবার নীতি বদলের পথ খোলা হয়, সেখানে ফিরে আসার প্রবণতা কি আর থাকে?
এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে ইতিহাসে। ১৯৩২ সালে ইবনে সৌদের হাতে গড়া সৌদি আরবের চরিত্র ছিল এক কঠোর ইসলামী অনুশাসনের প্রতিচ্ছবি। সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী এই রাষ্ট্রে ইসলামের বিধানই ছিল একমাত্র পথনির্দেশক। মদের মতো নিষিদ্ধ বস্তু শুধু আইনত নয়, সামাজিকভাবেও ছিল একেবারে পরিত্যক্ত। রাষ্ট্রীয় বেতার, শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা—সবই নির্মিত হয়েছিল শরিয়াহর আলোকে।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে সৌদি আরবের মুখাবয়ব। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’ প্রকল্পে আধুনিকতা আর অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকেই দেখা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে। এর অন্তরালে ঘটছে এক মৌন বিপ্লব, যার প্রথম শিকার হচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। বিনোদন শিল্প, সঙ্গীত উৎসব, মডেলিং শো, সিনেমা হল—যা একসময়ে নিষিদ্ধ ছিল, এখন রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। যেন এক দমিত আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ ঘটছে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণেই।
তবুও, মদের বৈধতা এক ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। কারণ এটি শুধু সামাজিক নয়, এটি ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন। কুরআন এখানে দ্ব্যর্থহীন—“ইন্নামাল খামরু ওয়াল মাইসিরু… রিজ্সুম মিন আমালিশ শাইতান”—খামর শয়তানের কাজ, আর তাই তা বর্জন করাই মুমিনের কাজ। সেই নির্দেশ এখন রাষ্ট্র নিজেই উপেক্ষা করছে, যদিও বলা হচ্ছে কেবল অমুসলিমদের জন্য। কিন্তু একবার যখন হারামকে বৈধতার ছায়ায় ঢেকে ফেলা হয়, তখন নিষেধ আর নিষেধ থাকে না—পরিণত হয় দৃষ্টান্তে।
সৌদি সমাজে এ নিয়ে চলছে নীরব দ্বন্দ্ব। যারা প্রতিবাদ করতে চান, তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ হচ্ছে রাষ্ট্রবিরোধী তকমায়। কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, কেউ আবার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আলেমসমাজের অনেকেই আজ কারাগারে, বাকিরা হয়তো মৌনতা বেছে নিয়েছেন আত্মরক্ষার প্রয়োজনে।
অপরাধ, বিলাসিতা ও বৈধতার অন্তরালে সৌদি আরব যেন এখন এক বৈচিত্র্যপূর্ণ সত্তায় বিভক্ত—একদিকে কাবা, অন্যদিকে কনসার্ট; একদিকে সীরাতের স্মৃতি, অন্যদিকে সুরা ও সাইডার। রাষ্ট্র চায় ধর্মকে আধুনিকতার সীমানায় সীমাবদ্ধ রাখতে—যেন এটি হয় একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাক, প্রয়োজনমতো যেটি পরা যাবে, আবার খুলেও রাখা যাবে।
এই যে দ্বৈততা, এটাই বিপদ। কারণ ধর্ম কখনও কৌশলের সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে না। ধর্ম চায় আত্মসমর্পণ, রাষ্ট্র চায় সুবিধাবাদ। এই দুইয়ের সংঘাতে আজ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সৌদি আরবের আত্মপরিচয়।
হয়তো একদিন হজ করতে আসা মুসল্লিরা নামবেন রিয়াদ বিমানবন্দরে, আর সেখানে দেখা যাবে দুই পাশে দুটি ব্যানার—একটিতে লেখা, “ওয়েলকাম টু দ্য ল্যান্ড অব তাওহীদ”, আর অন্যটিতে—“প্রিমিয়াম লাউঞ্জ: লাইসেন্সড ওয়াইন ফর ইনটেলিজেন্ট ট্রাভেলারস”।
সেই দিন যদি আসে, তখন আর শরিয়াহ কাঁদবে না। তখন কাঁদবে ইতিহাস—যে ইতিহাস একদিন লিখেছিল, “এই ভূমি আল্লাহর। এখন সে ইতিহাসই হয়তো বলবে, ‘এই ভূমি কার ছিল?’”
লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর