৩১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৪ঠা জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

আলোর পাণ্ডুলিপি, শাইখ আহমেদ আত-তাইয়্যেবের নিঃশব্দ প্রজ্ঞা

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

সময়ের গায়ে লিখে রাখা থাকে কিছু মানুষের নাম— নিঃশব্দ, অথচ চিরস্থায়ী। তাঁরা আলো করেন না নেভা বাতি জ্বেলে, বরং হন নিজেরাই একটি স্থির দীপ্তি, যা আলোকিত করে অন্ধকারের নিচ থেকে শুরু হওয়া নতুন ভোর। শাইখ আহমেদ আত-তাইয়্যেব হাফিযাহুল্লাহ তেমন একজন মানুষ। তিনি উচ্চারণ নন, তিনি অনুরণন; তিনি ভাষণ নন, তিনি মৌনতার ব্যাকরণ। মুসলিম বিশ্বের আধ্যাত্মিক চৌকাঠে দাঁড়িয়ে তাঁর জীবন এক বালাখানা, যার প্রতিটি দরজায় লেখা আছে— জ্ঞান, নৈতিকতা ও করুণা।

মিসরের দক্ষিণাঞ্চলের প্রাচীন শহর ‘কায়না’—যেখানে ইতিহাস এখনো মসজিদের মিনারে ঝুলে থাকে, বাতাসে ভেসে বেড়ায় তিলাওয়াতের ছায়া— সেই শহরেই ১৯৪৬ সালের জানুয়ারিতে জন্ম নেন আহমেদ আত-তাইয়্যেব। এক সুফি পরিবারে জন্ম তাঁর আত্মার ভিত গড়েছিল এক আলাদা আভিজাত্যে, যেখানে শিকড়ের সান্নিধ্য আর সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য একাকার হয়ে যায়। তাঁর শৈশব কেটেছে হিফজুল কুরআনের মর্মমূলে, আর কৈশোরে তিনি জেনেছেন দর্শনের সৌন্দর্য। তিনি বুঝেছেন— জ্ঞান মানে শুধু তথ্যের সংরক্ষণ নয়, বরং সত্যের দিকে পথচলা।

আল-আজহার— এক হাজার বছরের পুরোনো ইসলামী বিশ্ববোধের পীঠস্থান— তাঁকে আত্মস্থ করেছিল, আবার তিনিও আজহারকে নিজের গভীরতায় ঢেলে নতুন তাৎপর্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর অন্তর্জাগতিক যাত্রা— একজন গবেষক থেকে শিক্ষক, শিক্ষক থেকে নেতা, আর নেতা থেকে এক প্রতিভাসী আত্মদর্শনের প্রতীক হয়ে ওঠার অপূর্ব পরিণতি।

আহমেদ আত-তাইয়্যেব এমন একজন চিন্তক, যিনি বিশ্বাস করেন— ধর্ম কেবল আচার নয়, এটি আত্মার ভাষা। ইসলামকে তিনি বোঝেন এবং বোঝান প্রেমের আলেখ্য হিসেবে, যেখানে ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা ও তাওয়াক্কুল একটি সুরেলা সংগীতের মতো প্রবাহিত হয়। তাঁর বক্তব্যে থাকে না শ্লোগান, থাকে আত্মবিশ্বাস। তাঁর ভাষণে নেই কোলাহল, থাকে স্রোতের মতো স্তব্ধতা, যা ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে হৃদয়ের গভীরতম কুঠুরিতে।

তিনি যখন কথা বলেন, মনে হয় যেন সময় থমকে শোনে। তাঁর চোখ দুটি যেন প্রতিটি শব্দের আগে পড়ে নেয় মানুষের অন্তর্জগৎ, তারপর বলে শুধু প্রয়োজনীয়টি। এমনই এক কণ্ঠ, যেখানে উচ্চারণ হয় হিকমাহর; এমনই এক চাহনি, যেখানে প্রতিফলিত হয় সময়ের আত্মা।

তাঁর হাতে আল-আজহার পরিণত হয়েছে কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং এক সভ্যতার অভিভাবকতায়—যেখানে কিতাব ও ক্বালামের মাঝখানে নির্মিত হয় নৈতিকতার স্থাপত্য। আজহার তাঁর নেতৃত্বে হয়ে উঠেছে এক গ্লোবাল নৈতিক সংলাপের প্ল্যাটফর্ম—যেখানে ধর্ম কোনো দেয়াল নয়, বরং একটি সেতু।

বিশ্ব যখন ধর্মকে ব্যবহার করে বিভাজনের অস্ত্র হিসেবে, শাইখ আত-তাইয়্যেব তখন ধর্মকে ব্যাখ্যা করেন ভালোবাসার ছায়া হিসেবে। তাঁর সাহসিকতা প্রকাশ পেয়েছে ২০১৯ সালে, যখন তিনি পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে যৌথভাবে “মানব ভ্রাতৃত্বের দলিল” স্বাক্ষর করেন। এটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য এক হেলাল-ধ্বনি— যে পৃথিবী আজ ধর্মকে সন্দেহের চোখে দেখে, সে পৃথিবীতে তিনি তুলে ধরেন বিশ্বাসকে মানবতার আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখার দুর্লভ সৌন্দর্য।

এই যুগে, যেখানে ধর্ম আর জ্ঞান— দুইটিকেই পরস্পরের প্রতিপক্ষ করে দেখানো হয়, সেখানে তিনি প্রমাণ করেন: ধর্ম যখন গভীরভাবে অনুধাবিত হয়, তখন তা হয়ে ওঠে যুক্তির শ্রেষ্ঠ রূপ। তিনি এমন এক চিন্তাশীলতা রচনা করেন, যার রূপকলা দেখা যায় তাঁর বক্তব্যে, লেখনীতে ও নেতৃত্বের প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে।

তাঁর ব্যক্তিত্বে এক সুষম সংগীতের মতো স্পন্দিত হয় তিনটি ধারা: একদিকে সুফিবাদের প্রশান্তি, অন্যদিকে আকীদাহর বিশুদ্ধতা, আর তৃতীয়দিকে দর্শনের গভীরতা। তিনি যেন সময়ের দর্পণে প্রতিফলিত একজন আত্মজিজ্ঞাসার পথিক— যিনি জানেন, জ্ঞান মানে বই পড়া নয়, বরং মানুষকে পড়া; আর নেতৃত্ব মানে প্রভাব নয়, বরং দায়িত্ব।

আহমেদ আত-তাইয়্যেবের পথচলা নিঃশব্দ— কিন্তু প্রতিধ্বনি অসীম। তাঁর জীবন এক পাণ্ডুলিপি, যেখানে লেখা আছে নিরব অক্ষরে: কিভাবে অগণন শোরগোলের ভেতর থেকেও একজন মানুষ হিশেবে শান্তির সুরে কথা বলা যায়। তাঁর ভেতরে বাস করে এক গভীর বিশ্বাস— ইসলাম এমন এক ফুল, যা জোর করে ফোটানো যায় না, কেবল ভালোবাসায় প্রস্ফুটিত হয়।

লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো, মিশর

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

এই বিভাগের আরও খবর

মিশরে জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা গেছে, ঈদুল আজহা ৬ জুন

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান,মিশর মিশরে ১৪৪৬ হিজরি সনের জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা গেছে। দেশটির জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি মঙ্গলবার (২৭ মে) সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা

অবরুদ্ধ শরিয়তের ছায়ায় —মদের বৈধতায় সৌদি রাজতন্ত্রের নতুন পর্ব

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান “যেখানে শরিয়াহ কাঁদে, সেখানে রাষ্ট্রের নীরবতা সবচেয়ে জোরালো ভাষ্য হয়ে ওঠে।” সৌদি আরব—যে ভূমিতে পয়গম্বরের পা পড়েছিল, যেখানে ওহীর প্রথম

হজের পথে ডলারের স্রোত: আত্মশুদ্ধির মুখোশে আত্মঘাতী ব্যয়বিলাস

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান: হজ—মানবতার উচ্চতম আত্মসমর্পণ, হৃদয়ের নিঃশব্দ ক্রন্দন, ত্যাগের নিগূঢ় প্রতীক। পবিত্র কাবা ঘিরে লক্ষ লক্ষ সাদা ইহরামে মোড়ানো প্রাণের ঘূর্ণন যেন একটি

পবিত্র হজ: আত্মশুদ্ধির আলোকযাত্রা ও ইসলামে এর অপরিহার্যতা

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান যখন পবিত্র কাবা শরীফের আঙিনায় লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়—“লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক”, তখন আসমান-বাতাস যেন কেঁপে ওঠে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার

Scroll to Top