৩রা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৭ই জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

প্রজেক্ট এসথার: ফিলিস্তিনি অধিকার আন্দোলন দমনের নতুন হাতিয়ার

ইমতিয়াজ উদ্দিন:

যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি অধিকার আন্দোলনকে দমন করতে একটি সুপরিকল্পিত কৌশল হিসেবে হাজির হয়েছে প্রজেক্ট এসথার। রক্ষণশীল থিঙ্কট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন-এর তৈরি এই নীতিপত্রটি প্রথমে তেমন আলোচনায় আসেনি, কিন্তু গাজা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের সমালোচকদের বিরুদ্ধে এটি একটি শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রকল্পের আড়ালে যে রাজনৈতিক ও নীতিগত হস্তক্ষেপের চেষ্টা চলছে, তা আমেরিকার মত একটি গণতান্ত্রিক দেশে বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ।

প্রজেক্ট এসথার কী?

প্রজেক্ট এসথারের মূল লক্ষ্য হলো, ফিলিস্তিনি অধিকার আন্দোলনকে “হামাস-সমর্থিত নেটওয়ার্ক” হিসেবে চিহ্নিত করে এর অবকাঠামো ধ্বংস করা। হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের দাবি, ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কাজ করা সংগঠনগুলো পরোক্ষভাবে হামাসের এজেন্ডা এগিয়ে নিচ্ছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কিন্তু বাস্তবে, এই অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই। বরং এটি একটি কৌশলগত প্রচারণা, যার মাধ্যমে ইসরায়েলের নীতির সমালোচনাকারীদের দমন করা হচ্ছে।

ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনকে অপরাধীকারণের কৌশল

প্রজেক্ট এসথারের সুপারিশগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি শুধু হামাসকে টার্গেট করছে না, বরং যেকোনো ফিলিস্তিনি অধিকার সংগঠনকে “সন্ত্রাসী সহায়তাকারী” হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পদ্ধতি হলো:

1. বাকস্বাধীনতা হরণ: ইসরায়েলের নীতির বিরোধিতা করলে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ব্যক্তিদের ভিসা বাতিল, চাকরি ও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা।

2. অর্থনৈতিক চাপ: ফিলিস্তিনপন্থী সংগঠনগুলোর তহবিল বন্ধ করতে ব্যাংক ও অর্থপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি।

3. মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসরায়েল-বিরোধী কনটেন্টকে “ইহুদিবিদ্বেষী” বলে ফিল্টার করার আহ্বান।

4. আইনি হয়রানি: ফিলিস্তিন সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদি আইনি জটিলতায় ফেলা।

এই কৌশলগুলো শুধু ফিলিস্তিনি আন্দোলনকে দুর্বল করাই নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেও সংকুচিত করছে।

ট্রাম্প প্রশাসন ও প্রজেক্ট এসথারের যোগসূত্র

হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এই সংস্থারই আরেকটি বিতর্কিত প্রকল্প ‘প্রজেক্ট ২০২৫’ যা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে কর্তৃত্ববাদী শাসনের রূপরেখা হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রজেক্ট এসথারও একই ধারার অংশ—যেখানে ইসরায়েলের সমালোচনাকে দমন করে একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা জোরেশোরে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠন ও সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া

– জুইশ ভয়েস ফর পিস (JVP)-এর মতো ইহুদি সংগঠনগুলোকেও হামাসের সহযোগী বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

-এএমপি (American Muslims for Palestine) এর নির্বাহী পরিচালক ওসামা আবুইরশাইদ বলেছেন, “শুধু নামে মুসলিম শব্দ থাকার কারণে আমাদের টার্গেট করা হচ্ছে, এটি ইসলামবিদ্বেষেরই প্রকাশ।”

– জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ইতিমধ্যে গাজায় ইসরায়েলের অভিযানকে “জাতিগত নির্মূলরণ” বলে চিহ্নিত করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে কথা বলাকে অপরাধীকারণ করার চেষ্টা আন্তর্জাতিক আইন ও নৈতিকতার পরিপন্থী।

প্রজেক্ট এসথার শুধু একটি নীতিপত্র নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে একটি “চিন্তা নিয়ন্ত্রণ” এর প্রক্রিয়া। ফিলিস্তিনি অধিকার আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত করে এর সমর্থকদের criminalize করার এই চেষ্টা গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিকে ক্ষুণ্ণ করছে। যদি এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, তবে তা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলিম, প্রগতিশীল ইহুদি, এবং মানবাধিকারকর্মীদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সুশীল সমাজের উচিত এই ধরনের অপপ্রচার ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। কারণ, ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলার অধিকার হরণ করার অর্থই হলো—গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বলার অধিকার হরণ।

লেখক: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

এই বিভাগের আরও খবর

ইসলামী দলের ঐক্য পাল্টে দিতে পারে ভোটের হিসাব

আসগর সালেহী, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের অবস্থান সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রে। বিশেষ করে নির্বাচন সামনে এলে এই ঘরানার দলগুলোর ঐক্য ও সম্ভাব্য জোট নিয়ে

ক্ষুধার্ত গাজাবাসী: ওদের আহাজারী কারা দেখবে?

ইমতিয়াজ উদ্দিন: জাতিসংঘের সাম্প্রতিক সতর্কবার্তা নিঃসন্দেহে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে—গাজা এখন বিশ্বের সবচেয়ে খাদ্যসংকটপূর্ণ ও দুর্ভিক্ষ-প্রবণ অঞ্চল। শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে লুকিয়ে আছে

আলোর পাণ্ডুলিপি, শাইখ আহমেদ আত-তাইয়্যেবের নিঃশব্দ প্রজ্ঞা

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান সময়ের গায়ে লিখে রাখা থাকে কিছু মানুষের নাম— নিঃশব্দ, অথচ চিরস্থায়ী। তাঁরা আলো করেন না নেভা বাতি জ্বেলে, বরং হন

Scroll to Top