আসগর সালেহী, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের অবস্থান সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রে। বিশেষ করে নির্বাচন সামনে এলে এই ঘরানার দলগুলোর ঐক্য ও সম্ভাব্য জোট নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে ওঠে। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। সামনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যদিও নির্ধারিত তারিখ ঘোষণা হয়নি, তবে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে নানা মহলে আলোচনা। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না, তা এখন সবার আগ্রহের বিষয়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের বৈঠকের পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা বেড়েছে। এরপর রোববার রাজধানীর তোপখানা রোডের বিএমএ মিলনায়তনে ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের ঐক্যভাবনা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় দেশের প্রায় সব ইসলামী দলের শীর্ষ নেতারা একত্রিত হন।
বক্তারা সরাসরি বলেন, আওয়ামী সরকারের সময় সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে আলেম-উলামা। মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায়, ইসলামী আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিশেষ করে নিজেদের রক্তের দামে পাওয়া ইসলামী ঐতিহ্য রক্ষায় কোনো দ্বিধা রাখা যাবে না। তারা বলেন, এক প্ল্যাটফর্ম থেকে না লড়লে ইসলামী দলগুলোর ভবিষ্যৎ সংকটে পড়বে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন ও প্রতীক ইতিমধ্যে ফিরে পেয়েছে। দেশের বেশিরভাগ আসনে দলটি প্রার্থী তালিকা তৈরি করেছে। দলটি চাচ্ছে ইসলামী দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে একটি বড় জোট গড়তে। পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গেও দূরত্ব কমিয়ে এনেছে। তবে শেষ পর্যন্ত এককভাবে নির্বাচন করবে নাকি বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় যাবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মাঠের শক্তিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সন্তোষজনক ফলাফল করায় দলটি এবারের সংসদ নির্বাচনেও পুরোদমে নামার প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা নিজেদের প্রার্থীও চূড়ান্ত করছে। তবে জোটের ব্যাপারেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বে বেশ কিছু আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। ব্যক্তিগত ইমেজের কারণে মামুনুল হক এবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশও বৃহত্তর সিলেটসহ কয়েকটি আসনে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ চালাচ্ছে। নতুন আমির মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক নিজেও প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
খেলাফত মজলিস ও ইসলামী ঐক্যজোট কিছু আসনে নির্বাচন করার পাশাপাশি বৃহৎ জোটের ব্যাপারে ইতিবাচক রয়েছে। এছাড়া খেলাফত আন্দোলনের দুটি ভাগ, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ ছোট দলগুলোও বিচ্ছিন্নভাবে তৎপর।
বৃহস্পতিবার (২৯ মে) সন্ধ্যায় রাজধানীর পল্টনে খেলাফত মজলিস কার্যালয়ে পাঁচটি ইসলামী দলের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, জমিয়ত, নেজামে ইসলাম পার্টির শীর্ষ নেতারা।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়—এক আসনে একজন প্রার্থী দেয়ার জন্য কৌশল নির্ধারণ করা হবে এবং আগামী দিনে বিশিষ্ট আলেম-ওলামা ও দ্বীনদার বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আরও বৃহৎ মতবিনিময় সভা হবে।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৫৫টি দলের মধ্যে পাঁচটি দলের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। জামায়াত নিবন্ধন হারালেও বেশ সক্রিয়। বিএনপিসহ ১০টি দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। ছয়টি ধর্মভিত্তিক দল নির্বাচন পূর্ব সংস্কার চায়।
এদিকে, এনসিপি, এলডিপি, বাসদ, সিপিবি, গণফোরাম, এনডিএম, গণসংহতি আন্দোলন, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে।
আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ বেশিরভাগ দল ৫ আগস্টের পর থেকে নীরব। শুধু জাতীয় পার্টি দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে।
তবে ঐক্যের পথে রয়েছে বড় বাধা।
১. নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব
২. কে কার চেয়ে বড় — এই প্রতিযোগিতা
৩. বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা না স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম
৪. আসন বণ্টন নিয়ে বিরোধ
সবচেয়ে বড় কথা, জামায়াত, চরমোনাই এবং মামুনুল হকের খেলাফত মজলিস—এই তিন পক্ষ নেতৃত্ব প্রশ্নে এখনো একমত নয়। জমিয়তের অবস্থানও কিছুটা দ্বিধান্বিত।
বিশেষ সূত্র জানায়, যদি পিআর (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা অনুপাতভিত্তিক ভোট) পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হয়, তাহলে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ইতিমধ্যে কওমি ঘরনার পাঁচটি ইসলামী দল মোটামুটি ঐক্যমত হয়েছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, যে আসনে যার কর্মী-সমর্থক বেশি সেই দলের প্রার্থী হবে এবং সব দল তার জন্য কাজ করবে।
অন্যদিকে, যদি বিদ্যমান সরাসরি ভোটপদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, তাহলে নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও অন্যান্য ছোট দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী মোর্চা করে আসন সমঝোতার পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে মূল বিষয় হচ্ছে, তারা শেষ পর্যন্ত এক থাকতে পারবে কি না। কারণ, কওমি মাদরাসা ভিত্তিক অনেক ইসলামী দল এখনো বিএনপির প্রতি দুর্বল। তাদের ধারণা, আগামীতে সরকার গঠন করবে বিএনপি। তাই তারা ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামী নির্বাচনে যদি জামায়াত, চরমোনাই, এনসিপি এবং অন্যান্য ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিএনপির ১২ দলীয় জোটের মুখোমুখি হয়, তাহলে ভোটের সমীকরণ পাল্টে যেতে পারে। এমনকি বিএনপি ও তার মিত্রদের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হবে।
রাজনীতির মাঠে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা, আসন বণ্টন এবং বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নে ঐক্যের সম্ভাবনা এখনও ঝুলে আছে।
অতএব, এখন বলা যায়—ইসলামী দলগুলো ঐক্য হতে পারবে কি না, তা নির্ভর করছে আগামী দু-এক মাসের ভেতর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও সমঝোতার ওপর।