নিজস্ব প্রতিনিধি:
ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ভারতের বিমানবাহিনী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সংঘর্ষের তিন সপ্তাহ পর এই স্বীকারোক্তি মোদি সরকারের রাষ্ট্রীয় বর্ণনার ফাঁকফোকর উন্মোচন করে দিয়েছে। মে ২০২৫-এ পরিচালিত ব্যর্থ ‘অপারেশন সিঁদুর’ এ ব্যর্থতা ভারতের রাজনৈতিক প্রচারের বাস্তবতা প্রশ্নের মুখে ফেলে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কেবল একক ব্যক্তি নন; তিনি ভারতের ক্ষমতাসীন উগ্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতার প্রতীক। এই আদর্শই ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পথ প্রশস্ত করেছিল। হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর সদস্য, যে সংগঠনটি এখন বিজেপির আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। যদিও গডসে দাবি করেছিলেন তিনি সংগঠন ছেড়েছেন, বিবিসির তদন্ত বলছে তিনি কখনও তা করেননি। চাঞ্চল্যকরভাবে, একাধিক বিজেপি নেতা গডসেকে ‘দেশপ্রেমিক’ বলে প্রশংসা করেন।
আরএসএস অতীতে সহিংসতা ও ঘৃণার কারণে একাধিকবার নিষিদ্ধ হয়েছে—১৯৪৭ সালে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হামলা, ১৯৪৮ সালে গান্ধী হত্যা, ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ও ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর। সংগঠনটি ভারতের ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকা ও সংবিধানের বিরোধিতা করে এবং পরিবর্তে গেরুয়া পতাকা ও হিন্দুত্ববাদী শাসনব্যবস্থার পক্ষে মত দেয়।
মোদি সরকার প্রায়শই পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। অথচ, আরএসএস-এর সঙ্গে মোদির গভীর সম্পর্ক এবং ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম গণহত্যায় তার ভূমিকার কারণে পশ্চিমা মিডিয়া তাকে “গুজরাটের কসাই” হিসেবে অভিহিত করেছে। আরএসএসের সাবেক সদস্য যশবন্ত শিন্ডে স্বীকার করেছেন, তিনি মুসলিমদের দায়ী করে হিংসাত্মক কার্যক্রম চালাতে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
২০২৫ সালের মে মাসে সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র ধর্মীয় উগ্র নেতা জগদগুরু রামভদ্রাচার্যের সঙ্গে দেখা করেন, যিনি পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের দাবি করেন। এই ঘটনায় সেনাবাহিনীতে ধর্মীয় উগ্রতার অনুপ্রবেশের ইঙ্গিত মেলে।
এই রাজনৈতিক-সামরিক-ধর্মীয় ত্রিভুজ—মোদি, মোহন ভাগবত ও সেনাপ্রধান উপেন্দ্র—দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তির জন্য একটি বড় হুমকি। বিজেপি ও আরএসএসের ‘অখণ্ড ভারত’ ধারণা, যা আফগানিস্তান থেকে থাইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত, ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সিএনএন এটিকে ‘নব্য-সাম্রাজ্যবাদী কল্পনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
এই সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনায় অ-হিন্দুদের ‘ঘর ওয়াপসি’ কর্মসূচির মাধ্যমে ধর্মান্তরিত করার কৌশল রয়েছে। যদিও ভারতের সব হিন্দু এই আদর্শের সমর্থক নন, এই নীতির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে বিভাজন ও দমন নীতি চালানোর চেষ্টা চলছে।
একই সময়ে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা RAW ‘বঙ্গভূমি’ নামক একটি কথিত বাংলা হিন্দু রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করছে, যা বাংলাদেশের বিভাজনের শঙ্কা জাগায়। দ্য গার্ডিয়ান ও ওয়াশিংটন পোস্ট ২০২৪ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের প্রমাণ প্রকাশ করে, যেখানে পাকিস্তানে একাধিক টার্গেটেড কিলিংয়ের নেপথ্যে RAW-এর ভূমিকা তুলে ধরা হয়। গবেষক অবিনাশ পালিওয়াল তার বই My Enemy’s Enemy-তেও এসব সংযোগ নথিভুক্ত করেছেন।
মোদি দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক উত্তেজনা উসকে দিচ্ছেন। ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরিচালনায় মিথ্যা তথ্যের আশ্রয় নিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন, যেখানে কেবল ইসরায়েলই তার পাশে দাঁড়ায়।
সার্বিকভাবে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উচিত জাতিসংঘে ‘অখণ্ড ভারত’ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ জানানো। ভারতের নাগরিকদেরও উচিত, স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় ফিরে গিয়ে মোদি-ভাগবত-আরএসএস জোটের উগ্রবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া—যারা একদিকে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শকে পদদলিত করেছে, আরেকদিকে ভারতের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
সূত্র: যুগান্তর অনলাইনে এবং জিও নিউজ