৬ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১০ই জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

আরাফা: অনুতাপের কান্নায় ভিজে ওঠা আত্মার মুক্তির দিন

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান:

পৃথিবীর দিনগুলোর মাঝে কিছু কিছু দিন আছে যেগুলোতে আসমান যেন আরও নিকটবর্তী হয়ে আসে। বাতাস হয়ে ওঠে ভারী—আশা আর অনুশোচনায়। এমন এক অবিনাশী দিনের নাম ‘আরাফা’। কেবল একটি দিন নয়, এটি মুমিন হৃদয়ের জন্য এক আধ্যাত্মিক জাগরণ, আত্মা আর প্রভুর মাঝে পর্দাহীন সংলাপের এক মোহময় আয়োজন।

আরাফা আসে হৃদয়কে গলিয়ে দিতে, পাপভারে নুয়ে পড়া চোখ দুটোকে কান্নায় হালকা করে দিতে। এই দিন বান্দা আল্লাহর দরজায় এমনভাবে ফিরে আসে, যেন সে কখনো ফিরেইনি এত কাছাকাছি। বুকে জমে থাকা বহু বছরের অনুতাপ যেন এই দিনে গলে পড়ে, মাটিতে মিশে যায় মাফের বৃষ্টিতে।

এই দিনেই পূর্ণতা পেয়েছিল ইসলাম। ইতিহাসের গভীরতম মুহূর্তে, আরাফার প্রান্তরে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) ঘোষণা করেছিলেন সেই আয়াত, যা আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়ে মানবজাতিকে জানিয়ে দিয়েছিল—

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।”
(সূরা আল-মায়েদা, আয়াত ৩)

এটি কোনো সাধারণ বার্তা ছিল না। এটি ছিল এক চূড়ান্ত আলোকবর্তিকা, যার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের জীবনে নেমে আসে পথের দৃশ্যমানতা। একে ঘিরেই গড়ে ওঠে আত্মার মুক্তির কাঠামো।

আরাফার দিন হলো সেই দিন, যেদিন আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সবচেয়ে বেশি ক্ষমা করেন। ফেরেশতারা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে মাটির দিকে, যেখানে হাজার হাজার হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে প্রভুর দরবারে পড়ে আছে। নবীজি (সা.) বলেছিলেন—

“আল্লাহ্‌ তায়ালা আরাফার দিন সর্বাধিক সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। এবং তিনি ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করে বলেন—তোমরা দেখো, আমার বান্দারা এলোমেলো চুলে, ধূলিমাখা হয়ে এসেছে আমার কাছে।”
(সহিহ মুসলিম, হাদীস: ১৩৪৮)

সেই দৃশ্য কল্পনা করুন—যেখানে পবিত্র আরাফাতের মাঠ জুড়ে কান্না, দোয়া আর তাওবার ছায়া। একবুক পাপ নিয়ে বান্দারা দাঁড়িয়ে, আর আসমান খুলে যাচ্ছে অনুগ্রহের দরজা দিয়ে।

আরাফার দিনে রোযা রাখার যে ফজিলত তা এক অলৌকিক আশীর্বাদ। রাসূল (সা.) বলেছিলেন—

“আশা করি, আল্লাহ আরাফার দিনের রোযার বিনিময়ে পূর্ববর্তী এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।”
(সহিহ মুসলিম, হাদীস: ১১৬২)

একটি মাত্র দিন, অথচ বিনিময়ে পুরো দুই বছরের পাপ মোচনের প্রতিশ্রুতি! একদিনের ক্ষুধা, কিন্তু অনন্ত জীবনের পাথেয়।

এই দিনটি এমন একটি দরজা, যা মুমিনের জন্য চিরকাল খোলা থাকে—তবে সে বুঝতে পারলে। এই দিন, যেখানে একটি চোখের জলই হয়ে ওঠে চাবিকাঠি, একটি ‘আল্লাহুম্মাগফিরলি’ হয়ে যায় মুক্তির সেতু। দোয়ার এমন একটি সময়, যখন আকাশের দরজাগুলো থাকে উন্মুক্ত, এবং বান্দার নিঃশব্দ মিনতি ফিরে যায় না।

নবীজি (সা.) এই দিনটির দোয়ার মর্যাদা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন—

“সর্বোত্তম দোয়া হলো আরাফার দিনের দোয়া।”
(তিরমিযী, হাদীস: ৩৫৮৫)

তাই এই দিনে বান্দা কাঁদে, চায়, ডাকে। হৃদয় খোলে, পাপ ঝরে, আত্মা নরম হয়। কী অপার সৌন্দর্য এই দিনের! কোনো অলংকার লাগে না দোয়ার। শুধু একটি অনুতপ্ত হৃদয়ই যথেষ্ট।

আরাফা আমাদের বলে—তুমি যত গোনাহ করো না কেন, ফেরার পথ এখনো খোলা। যতদিন এই দিনকে অনুভব করতে পারো, ততদিন মুক্তির আশা হারায় না। এই দিন আত্মাকে শুদ্ধ করার দিন, পাপকে পেছনে ফেলে দেওয়ার দিন। এই দিন এক জীবন্ত সাক্ষ্য, যে মাফ এখনো সম্ভব, ক্ষমা এখনো আসে, করুণা এখনো ঝরে পড়ে।

আসুন, এই আরাফা আমরা ফিরি। পৃথিবীর সব গর্জন পেছনে ফেলে একবার দাঁড়াই সেই করুণাময়ের সামনে। হৃদয়ের আরাফা তৈরি করি, যেখানে প্রভুর জন্য রাখা থাকবে কান্না, ভালোবাসা আর লজ্জা। যেখানে আমরা নিজেকে দিই, আর বিনিময়ে পাই শান্তি, পাই মুক্তি।

লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

এই বিভাগের আরও খবর

ইসলামী দলের ঐক্য পাল্টে দিতে পারে ভোটের হিসাব

আসগর সালেহী, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের অবস্থান সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রে। বিশেষ করে নির্বাচন সামনে এলে এই ঘরানার দলগুলোর ঐক্য ও সম্ভাব্য জোট নিয়ে

ক্ষুধার্ত গাজাবাসী: ওদের আহাজারী কারা দেখবে?

ইমতিয়াজ উদ্দিন: জাতিসংঘের সাম্প্রতিক সতর্কবার্তা নিঃসন্দেহে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে—গাজা এখন বিশ্বের সবচেয়ে খাদ্যসংকটপূর্ণ ও দুর্ভিক্ষ-প্রবণ অঞ্চল। শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে লুকিয়ে আছে

প্রজেক্ট এসথার: ফিলিস্তিনি অধিকার আন্দোলন দমনের নতুন হাতিয়ার

ইমতিয়াজ উদ্দিন: যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি অধিকার আন্দোলনকে দমন করতে একটি সুপরিকল্পিত কৌশল হিসেবে হাজির হয়েছে প্রজেক্ট এসথার। রক্ষণশীল থিঙ্কট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন-এর তৈরি এই নীতিপত্রটি প্রথমে তেমন

Scroll to Top