১৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২১শে জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

রক্তঋণ ও আত্মঘোষিত দম্ভের উপাখ্যান — ইরান বনাম ইহুদি সংঘাত, আরব ভাঙনের প্রতিচ্ছবি জর্ডান-সিরিয়ার নিঃশব্দ কূটনীতি

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান:

মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে এখন সীমান্তের রেখাগুলো রক্ত দিয়ে আঁকা, আর তার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে কিছু রাষ্ট্র—বিপন্ন, বিহ্বল, এবং বিবর্ণ কূটনীতির বাকি কোলাজে রং খুঁজে ফেরে তারা। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কাঁপুনিতে যখন গাজার ইট, লেবাননের পাথর আর ইয়েমেনের ধুলো শত্রু আর মিত্রের পার্থক্য ঘোলাটে করে তোলে, তখন সেই কাঁপুনি গিয়ে পৌঁছে জর্ডানের রাজপ্রাসাদ আর দামেস্কের ধ্বংসস্তূপেও। এখানেই শুরু হয় আরেক অধ্যায়—নীরবতায় লেখা কূটনৈতিক নাট্যরচনা, যেখানে কথার চেয়ে ছায়াই বেশি সরব।

জর্ডান—এক অদ্ভুত দ্বৈততার দেশ। একদিকে পশ্চিমা অর্থনীতি ও আমেরিকান সামরিক ছাতার নিচে আশ্রয়প্রাপ্ত, অন্যদিকে জাতিগত চেতনায় গাঁথা একটি আরব আত্মা, যার শিরায় এখনো প্রবাহিত হয় ফিলিস্তিনের শোক। রাজা আবদুল্লাহ দ্বিতীয়—যিনি নিজেকে ঘোষণা করেন জেরুজালেমের পবিত্র স্থানসমূহের অভিভাবক, অথচ তেলআবিবের সঙ্গে তাঁর সরকারের নিরাপত্তা সমঝোতা চলে প্রতিদিন। এই দ্বন্দ্ব জর্ডানের কূটনীতিকে একধরনের শ্বাসরুদ্ধ ভারে রেখেছে—যেখানে তিনি ফিলিস্তিনিদের জন্য আহাজারি করেন জাতিসংঘে, অথচ বিমানঘাঁটিতে নামতে দেন ন্যাটোর সশস্ত্র বিমানেরা।

২০২৫-এর ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ জর্ডানকে নিয়ে গেছে এক জটিল অগ্নিপথে। ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সহানুভূতির কারণে জর্ডানজুড়ে ব্যাপক জনরোষ, লাখো মানুষের প্রতিবাদ মিছিল। কিন্তু রাজপ্রাসাদের ভেতর শান্তভাবে চলে কূটনৈতিক ব্যালান্স—একদিকে তেলআবিবের প্রতি সতর্কতা, অন্যদিকে ওয়াশিংটনের পরামর্শে ‘স্থিতিশীলতা রক্ষার’ নামে গোপন সহযোগিতা। এ এক দুর্বিষহ কূটনীতি—যেখানে জর্ডান প্রতিদিনই দুই মুখো প্রতিচ্ছবিতে নিজেকে রক্ষা করে, অথচ জানে—গাজা দগ্ধ হলে, সেই আগুনের ছাই একদিন পৌঁছবেই আম্মানে।

আর সিরিয়া—এক অন্ধকার মহাকাব্যের নাম, যেখানে প্রতিটি অনুচ্ছেদ লেখা হয় বারুদের অক্ষরে। বাশার আল-আসাদের সরকার এখন আর কূটনীতিকে জনমত রক্ষার অস্ত্র নয়, বরং রাষ্ট্রীয় বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয় মনে করে। ২০১১-র গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত, ভেঙে পড়া এক রাষ্ট্র আজ দাঁড়িয়ে আছে রাশিয়ার সহায়তায় এবং ইরানের সামরিক হস্তক্ষেপে টিকে থাকা এক ছায়া-প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে। দামেস্ক এখন আর স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, বরং ইরান-রাশিয়া-হিজবুল্লাহ জোটের একটি কৌশলগত ব্যূহ, যেখান থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছোড়া হয় সতর্ক হুঙ্কার আর সীমিত রকেট।

সিরিয়ার কূটনীতি এখন একধরনের ভয়ঙ্কর খেলা—যেখানে মুখে শান্তির আহ্বান, আর বাস্তবে নিজেদের মাটিকে পরিণত করেছে ছায়া-সংঘাতের পরীক্ষাগারে। বাশার সরকার আন্তর্জাতিক মঞ্চে বলছে—”আমরা আরব ঐক্যের পক্ষে, আমরা ফিলিস্তিনিদের পাশে,” অথচ বাস্তবতায় সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চল হয়ে উঠেছে ইরানপন্থী মিলিশিয়াদের ট্রানজিট রুট, যা দিয়ে হিজবুল্লাহর হাতে পৌঁছে যাচ্ছে অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরায়েল অন্তত ছয়বার বোমাবর্ষণ চালিয়েছে সিরিয়ার অভ্যন্তরে—লক্ষ্য শুধু হিজবুল্লাহ ঘাঁটি নয়, বরং তেহরানের প্রযুক্তিগত চর্চাকেন্দ্র, ড্রোন কারখানা, এবং রকেট লঞ্চিং স্থাপনাও। দামেস্ক এসব নিয়ে নীরব থাকে, কারণ জানে—প্রতিশোধ এখন তাদের সামর্থ্যের বাইরে।

তবে এই নীরবতাই একদিন বিস্ফোরিত হবে। সিরিয়া জানে, তার ভূমি হয়ে উঠছে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে প্রধান ফ্রন্ট, এবং এই সংঘাতে সে আর নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না।

এই দুটো রাষ্ট্র—জর্ডান ও সিরিয়া, আজ এক দ্বিধাগ্রস্ত মঞ্চের দুই বিপরীত অংশ। একদিকে নিয়ন্ত্রিত নিরপেক্ষতা, অন্যদিকে শর্তাধীন পক্ষপাত। জর্ডান যে শান্তির চেয়ে স্থিতাবস্থাকে বেছে নিচ্ছে, তা এক চোখের কূটনীতি—যা হয়তো অস্তিত্ব রক্ষা করে, কিন্তু মর্যাদাহানি নিশ্চিত করে। আর সিরিয়ার পথ—এক অন্ধ বিশ্বাসের পথ, যেখানে তারা আর নিজের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করে না, কেবল শত্রুদের লক্ষ্যে নিজ ভূমিকে ব্যবহৃত হতে দেয়।

এই দুই ভূখণ্ডের ভূমিকাই প্রমাণ করে, মধ্যপ্রাচ্যে আর কেউই নির্দোষ নয়। যে চুপ থাকে, সে ভূমিকা নেয়। যে লড়াইয়ে নামে না, সে পথ করে দেয় দখলদারদের।

এটাই হলো আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি—কবিতা নয়, বরং কাঁটার মালা। এখানে ভাষা নয়, ভূমি কথা বলে। আর কথা বলার সময় শেষ হলে, মাটিই সাক্ষ্য দেয় রক্তের।

লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো,মিশর

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top