মোঃ আমিরুল হক, রাজবাড়ী প্রতিনিধি:
“দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া, ঘর থেকে শুধু দু’পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু।” আজ আমাদের সমাজের অনেক কিছুই অজানা রয়ে যায়। কেউ খেয়াল রাখেনা কারো দিকে। জীবন চলার পথে মানুষ অনেক দুরের দৃশ্য দেখতে যায়। অথচ আমাদের পাশেই পাড়ে রয়েছে এমন একটি পরিবার যাদের দেখলে দুই নয়ন পানিতে ভরে যাবে। এমন একটি পরিবারকে নিয়েই দৈনিক রাজবাড়ী কণ্ঠের এই প্রতিবেদন।
একই পরিবারে মানসিক, শারীরিক ও বাক ৩ প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বৃদ্ধ, দরিদ্র ও অসহায় বাবা মা। যে বয়সে ছেলেদের উপর নির্ভরশীল থাকার কথা বাবা মায়ের সেখানে প্রাপ্তবয়স্ক এক ছেলে এবং দুই মেয়েসহ তিনজনকে দেখাশোনা করতে হচ্ছে ৮০ বছরের উপাজর্নে অক্ষম বৃদ্ধ বাবা ও ৭০ বছরের রোগাক্রান্ত মায়ের।
চরম অর্থকষ্টের মধ্যেও স্নেহের মায়ায় বেঁধে রেখেছেন প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের এমন একটি পরিবারের কথাই বলছি,রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের বাড়াদী গ্রামের বৃদ্ধ লোকমান মন্ডল (৮০)ও তার স্ত্রী (৭০) এর কথা।
জানা যায়, লোকমান মন্ডলের, নয় সন্তানের মধ্যে পাঁচজনই শারীরিক,মানসিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ায় মনে দুঃখ থাকলেও কখনই প্রকাশ করেননি তিনি। ছেলেমেয়েদের বুকে আগলে রেখেছেন অকৃত্রিম ভালোবাসায়।
উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের বাড়াদী গ্রামের পুরাতন টিনের ছাউনির ভাঙ্গাচোরা দুইরুম বিশিষ্ট একটি বাড়িতে বসবাস করেন। বাড়ির সর্বত্র রয়েছে চরম দারিদ্র্যের ছাপ। কিন্তু স্নেহ-ভালোবাসার সামান্যতম ঘাটতি নেই এই পরিবারটির মানুষগুলোর মধ্যে।
অসহায় লোকমান মন্ডল বলেন,একসময় তিনি অন্যের বাড়িতে জন বিক্রি করে সংসার চালাতেন।তখন বেশ মোটামুটি সংসারটি ভালোই চলছিলো। সেই তিনিই বয়সের ভারে চোখে দেখেন কোন রকম এখন কাজ তো দূরের কথা নিজেই চলাচলে অক্ষম।
পাঁচ প্রতিবন্ধীর মধ্যে জন্মগত ভাবে ছিলেন তিনজন। এদেরই দুইজন সম্প্রতি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এখনও তিনি বাঁকি তিন ছেলেমেয়েকে বুকে আগলে রেখেছেন।
এদের মধ্যে তারাবিবির (৪৫) হঠাৎ ১২ বছর বয়স থেকে ধীরে ধীরে দুটি হাত, দুটি পা শুকিয়ে চিকুন হতে লাগলো। তার কিছুদিন পর দুর্বল হয়ে পড়েন সেই থেকেই আর কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারেননি তিনি। এমনকি হুইল চেয়ারেও বসতে পারেন না। সামান্য পায়ে ভর এবং হাতে ভর দিয়ে জির্ণশির্ণ টিনের চালার ঘরের মধ্যে চলা ফেরা করেন কোন রকম।
মোঃ জাহাঙ্গীর মণ্ডল (৩২) শারীরিকভাবে অক্ষম কোন ভাবেই চলা ফেরা করতে পারেন না তিনি। চলা ফেরা করতে হয় অন্যের সাহায্য বা সহযোগিতা নিয়ে।
অপর সন্তান সীমা খাতুন (২০) জন্ম থেকেই শারীরিক মানসিক ও বাক প্রতিবন্ধী।
এই তিন প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েকে ঘিরে সংগ্রাম ও ত্যাগের জীবন লোকমান মন্ডলের। হার না মানা এই সংগ্রামে প্রাপ্তি শূন্য জেনেও হাসিমুখে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিবন্ধী সন্তানদেরকে। তবে চাপা আক্ষেপ আছে তার মনে। চরম দারিদ্র্যের কারণে ঈদ বা উৎসবে ছেলেমেয়েদের ভালো খাবার, নতুন পোশাক দিতে পারেননি কখনোই। অভাবী সংসারে এদের দেখাশোনা, চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। বয়সের কারণে উপার্জনে অক্ষম হওয়ায় প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের সামান্য সরকারি ভাতার টাকায় সংসার চলাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
প্রতিবন্ধীদের বাবা মা বলেন, একদিকে অভাব আরেক দিকে চিন্তার ভাজ “এখন তো বেঁচে আছি”দেখাশুনা করছি, তবে আমাদের মৃত্যুর পর কিভাবে কাটবে তাদের জীবন।
ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মোহন রায়হান বলেন, এই পরিবারটিতে পাঁচজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন এদের মধ্যে দুজন মারা গিয়েছেন। বাকি তিনজন ও বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন। আমরা সরকারি সব ধরনের ভাতার ব্যবস্থা করেছি। আমি মনে করছি আপনাদের গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রচারের মধ্য দিয়ে এই পরিবারটিকে সমাজের অনেক বিত্তবান ও দানশীল লোকেরা দেখবেন, তাদের মধ্যে কেউ না কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেন বলে আশা করছি।