২০শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৪শে জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

রাজশাহী কলেজে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ রায়হান আলীর নাম বিকৃতি

আবু রায়হান, রাজশাহী কলেজ প্রতিনিধি:

জুলাই বিপ্লবে রাজশাহী কলেজের একমাত্র শহীদ রায়হান আলীর স্মরণে একটি নতুন ভবনে তার নামে নামকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কলেজ প্রশাসন। তবে সেই নামকরণে নাম বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে কলেজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। নতুন দশ তলা সেই ভবনের নামফলকে ‘শহীদ রায়হান আলী ভবন’ এর পরিবর্তে লেখা হয়েছে ‘শহীদ রায়হান ব্যবসায় প্রশাসন ভবন’।

শুক্রবার (২০ জুন) সকালে বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর থেকেই এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজশাহীতে পুলিশ ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী বাহিনীর সাথে ছাত্র-জনতার গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আইসিইউয়ে তিনদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ আগস্ট শাহাদাতবরণ করেন ছাত্রনেতা রায়হান আলী। তাঁর আত্মত্যাগকে স্মরণ করে ভবনের নামকরণ হলেও ‘আলী’ শব্দটি বাদ দিয়ে এবং বিভাগীয় নাম জুড়ে দিয়ে শহীদের পূর্ণ পরিচয় বিকৃত করা হয়েছে বলে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষার্থীরা শঙ্কা প্রকাশ করে জানান, আওয়ামী দোসরদের প্রত্যক্ষ মদদে পরিকল্পিতভাবে শহীদের নামকে খাটো করতেই এ প্রচেষ্টা চালানো হতে পারে। শাহাদাতের মাত্র এক বছর না পেরোতেই শহীদের নাম নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা হলে ভবিষ্যতে হয়তো তাঁর অবদান সব জায়গা থেকেও মুছে ফেলা হবে। ছাত্র-জনতার রক্ত পেরিয়ে প্রশাসনের গুরু দায়িত্ব গ্রহণের পর শহীদদের অবমাননা সাধারণ শিক্ষার্থীরা মেনে নিবে না বলেও প্রশাসনকে সতর্ক করেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী রাফিন বলেন, শহীদের ‘আলী’ বাদ দিয়ে শুধু ‘রায়হান’ বলার মানে তাঁর প্রকৃত পরিচয় মুছে ফেলা হয়েছে। এটা কোনো সাধারণ নাম নয়, একজন শহীদের নাম। নাম বিকৃতি মানে ইতিহাস বিকৃতি।

রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মাহমুদুল হাসান বলেন, তৎকালীন অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক স্যার এই দশতলা ভবনটির নাম শহীদ রায়হান আলীর নামে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমরা তখন প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে সকল ভবনের নাম স্বৈরাচারদের নামে রয়েছে, সেগুলোর নাম জুলাই বিপ্লবের শহীদদের নামে নামকরণ করতে হবে। সেই ধারাবাহিকতায় এই ভবনের নাম শহীদ রায়হান আলীর নামে নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে শহীদের পূর্ণাঙ্গ নাম ব্যবহার না করে সংক্ষিপ্ত ও বিকৃতভাবে নামটি টানানো হয়েছে, যা শহীদের প্রতি অসম্মান। আমরা বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছিলাম যে নামটি ভুল হচ্ছে। এরপরও কেন ভুল নাম টানানো হলো তা আমাদের বোধগম্য নয়।

রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক খালিদ বিন ওয়ালিদ আবির বলেন, শহীদদের নাম বিকৃতি করা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাজনক। আমরা শুরু থেকেই শহীদ শাকিব আঞ্জুমের পুরো নাম ব্যবহারের দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু কলেজ প্রশাসন তখন শুধু ‘সাকিব’ কিংবা ‘আঞ্জুম’ নামটি ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। তখনই আমরা বলেছিলাম, একজন শহীদের পূর্ণ নাম ছাড়া তাঁর পরিচয় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ঠিক একইভাবে শহীদ রায়হান আলীর ক্ষেত্রেও যদি শুধু ‘রায়হান’ নাম ব্যবহার করা হয় তাহলে তার ইতিহাস ও পরিচয় বিকৃত হবে।

তিনি আরও বলেন, কলেজ প্রশাসন বারবার ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি না তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কেন শহীদদের নামকে ছোট করার চেষ্টা করছে। এই কলেজ ও ভবন যাদের রক্ত ও ত্যাগের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে সেই শহীদের নাম বিকৃত করা মানে তাদের সম্মানহানি এবং ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা। এটি অত্যন্ত কষ্টদায়ক ও নিন্দনীয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মেশকাত চৌধুরী মিশু বলেন, একজন শহীদকে যখন ধারন করবো তখন যেন তার পুরো নামটায় থাকে। শত বছর হাজার বছর পরেও যেন তার এই আত্মত্যাগটা মানুষ রাখতে পারে। যেহেতু উনার নামটা স্মরণ করার জন্য ওই নামে নামকরণ করা হয়েছে সেখানে পুরো নামটা দিলে ভালো হতো। কলেজ প্রশাসনের উচিত তার পুরো নামটা দেওয়া।

রাজশাহী মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি আকবর আলী জ্যাকি বলেন, একজন শহীদের নাম যদি দিতে হয় তাহলে পুরো নামটা দিতে হবে, অর্ধেক নাম দিলে তাকে অবমাননা করা হবে। যদি নাম ব্যবহার না করে সেটা আলাদা। তবে যদি নাম দিতে হয় তাহলে পুরো নাম দিতে হবে। কলেজ প্রশাসন মনে হয় নাম দিতে চায় না তবুও দিচ্ছে। কিছুদিন পরে এই নাম তুলে ফেলতেও পারে।

রাজশাহী মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোহা. শামীম উদ্দীন বলেন, একজন শহীদের নামের ফলক দেওয়ার ক্ষেত্রে কলেজ প্রশাসনকে আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া দরকার ছিল। যাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে জুলাই বিপ্লব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমরা নতুন একটি দেশ পেয়েছি তাদেরকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করতে হবে। শহীদদের এই ধরনের নামের অবমাননা ছাত্র সমাজ মেনে নিবে না।

তিনি আরও বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি, কলেজের যে সমস্ত ভবন স্বৈরশাসকদের নামে বা তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে নামকরণ করা রয়েছে, সেগুলিকে বাদ দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই সমস্ত ভবনগুলো জুলাই বিপ্লবের শহীদদের নামে নামকরণ করা উচিত। তবে তাদের নাম বিকৃতি যেন না হয় সে দিকেও যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

এদিকে শহীদের নাম বিকৃতির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মু. যহুর আলী। তিনি বলেন, ‘যাদের দায়িত্ব দেওয়া ছিল তারা হয়তো লেখার সময় ভুলবশত আলী শব্দটি বাদ দিয়েছেন।’ তবে আলী শব্দ বাদ পড়ার বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানোর পরও ভুল নামফলক লাগানোর প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ জানান, ‘এটা সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্ব থাকা স্যাররা বলতে পারবেন। হয়তো পরবর্তীতে এটা সংশোধন হতে পারে।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top