জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান, লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মিশর
একটি ছবি। ঝড়ের আকাশ পেছনে, সামনে এক তরুণী। তাঁর গায়ে ছেঁড়া কাপড়—তবে তা কেবল কাপড় নয়, সেটি বাংলাদেশের পতাকা। সবুজ জমিনে লাল বৃত্তের মাঝখানে তার বুক, আর সেই পতাকাটি কারও টানে ছিঁড়ে যাচ্ছে। মেয়েটি নির্ভীক, মুখ তুলে তাকিয়েছে আকাশের দিকে। প্রতিকূলতায় ভরা চোখ, অথচ তাতে আতঙ্ক নেই, আছে এক অদ্ভুত অভিমান।
এই দৃশ্য কেবল একটি শিল্পচিত্র নয়—এটি বাংলাদেশের ইতিহাস, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের অদৃশ্য আর্তনাদের বহিঃপ্রকাশ। পতাকা আর নারী—দুইটি প্রতীক যখন এক ফ্রেমে এসে দাঁড়ায়, তখন তা শুধু আবেগ নয়, এক জাতির আত্মবিশ্লেষণ হয়ে ওঠে।
এই পতাকার জন্য একদিন নারীরা সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিত নারীর সংখ্যা আনুমানিক দুই লাখ—তাদের শরীরে খচিত হয়েছিল বিজয়ের দাম। অথচ আজও, এই স্বাধীন দেশে সেই নারীই যেন সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। বাড়ি থেকে রাস্তায়, আদালত থেকে সংসারে—সর্বত্র তার শরীরে লেগে আছে লোলুপ হাতের আঁচড়, নীরবতায় মিশে আছে শত সহস্র টান।
এই ছবি আমাদের চুপ থাকা চোখের সামনে এক বিস্ফোরক বাস্তবতাকে তুলে ধরে। পতাকা ছেঁড়া মানে শুধু কাপড় ছেঁড়া নয়, এটি একটি সমাজব্যবস্থার আত্মঘাতী লজ্জা। কেউ যদি নারীর গায়ে হাত দেয়, সে আসলে একটি জাতির মুখে থাপ্পড় মারে। নারীকে অপমান করা মানে সেই পতাকাকে অপবিত্র করা—যে পতাকা জাতীয় সঙ্গীতে আমরা শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করি, সেই পতাকা যেন প্রতিদিন পুড়ছে, ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে আমাদের চোখের আড়ালে।
তবুও আমরা চুপ। আমরা ব্যস্ত উৎসব আর রং, বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ আর মার্চ মাসের ফুলেল পথসভায়। আমরা নারী দিবসে গোলাপ দিই, অথচ তার পেছনের রক্তাক্ত গল্প শুনতে চাই না। আমরা মঞ্চে বলি “নারী এগিয়ে যাচ্ছে”, আর একই সঙ্গে তার চরিত্র নিয়ে কানাঘুষা করি যখন সে নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলে।
রাষ্ট্র এখানে শুধু নীরব নয়, অনেক সময় অপরাধীও বটে। বিচার পেতে হয়রানি, ধর্ষণের ঘটনায় মামলা না নেওয়ার প্রবণতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা—সব মিলে নারীর সামনে এক বিভীষিকাময় দেয়াল। সেই দেয়াল পেরিয়ে কেউ যখন কথা বলতে চায়, তখন তার মুখ বন্ধ করতে ছুটে আসে সামাজিক ভয়, ধর্মের অপব্যাখ্যা কিংবা রাজনৈতিক চাপ।
ছবির মেয়েটি কোনো বাস্তব চরিত্র না হলেও, সে আমাদের চারপাশে হাঁটা প্রতিটি নারী। কখনো তিনি পথশিশু, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কখনো গার্মেন্টস কর্মী, কখনো গৃহবধূ। তারা সবাই এই পতাকার শরীরে বসবাস করে, আর সেই শরীর প্রতিনিয়ত ক্ষত বয়ে চলে।
তাদের কারো কণ্ঠে আর আর্তনাদ নেই, কেবল অভিমান। ঠিক যেমন ছবির সেই মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে—তার চোখে কোনো সাহায্যপ্রার্থনা নেই, কেবল এক গভীর প্রশ্ন: “এই স্বাধীনতা কি কেবল পুরুষের জন্য?”
এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের দিতে হবে, কারণ যারা প্রশ্ন করে না, তারা ইতিহাসের আবর্জনায় বিলীন হয়ে যায়। নারীকে যদি আমরা নিরাপত্তা না দিতে পারি, সম্মান না দিতে পারি—তবে এই পতাকাকে আমরা আর ধরার যোগ্য নই।
শুধু টানলেই পতাকা ছিঁড়ে যায় না, তা ছিঁড়ে যায় যখন আমরা মৌন থাকি অন্যায়ের সামনে, চোখ ফিরিয়ে থাকি যখন নারী আর্তনাদ করে, আর বিবেক বেচে দিই সুবিধার বিনিময়ে।
আজকের এই ছবি এক দৃষ্টিকোণ নয়, একটি দর্পণ। যেখানে আমরা নিজেরাই নিজের মুখ দেখতে পাই—একটা বর্ণিল পতাকার আড়ালে লুকানো গোপন কাপুরুষতা। পতাকা তখনই সত্যিকার অর্থে উড়বে, যখন একজন নারী আর তাঁর মর্যাদার মধ্যে থাকবে না কোনো হাত, কোনো টান, কোনো ভয়।
তখনই এই জাতির পতাকা সত্যিই পূর্ণ হবে—একটি গোটা, অক্ষত, রক্তে নয়, ভালোবাসায় রাঙা।