৩০শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৫ই সফর, ১৪৪৭ হিজরি

শব্দহীনতার অন্ধকারে জ্বলে ওঠে তৃষার থেরাপির আলো

আরাফাত হোসাইন, বাকৃবি প্রতিনিধি:

মুখের ভাষা মানুষের আত্মার দর্পণ যেখানে অনুভূতিরা শব্দে রূপ পায়, ব্যথারা ব্যাখ্যা খোঁজে, আর ভালোবাসা পাখি হয়ে উড়ে যায় অন্যের হৃদয়ে। অথচ যাদের মুখ নিঃশব্দ, তাদের যন্ত্রণা নীরব এক আর্তনাদ। বলার চেষ্টা থাকলেও শব্দ হয় না, কণ্ঠে আটকে থাকে হৃদয়ের ঝড়। কারও হাত ছুঁয়ে বোঝাতে হয় ভালোবাসা, চোখের জল দিয়ে বলতে হয় কষ্টের গল্প। মুখের ভাষা না থাকা যেন আলোহীন একটি দিন সেখানে রং আছে, দৃশ্য আছে, কিন্তু উষ্ণতা নেই। ভাষাহীন সেই মানুষগুলো প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে নিজেকে প্রকাশের, বোঝানোর, স্বীকৃতি পাওয়ার। তাদের নীরবতা এক অনুচ্চারিত কবিতা, যে কবিতা শব্দ নয়, অনুভবে লেখা। তাই মুখের ভাষার গুরুত্ব শুধু কথায় নয়, তা জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী সেতু যা না থাকলে মন হয় বন্দী, প্রাণ হয় নিঃসঙ্গ, আর হৃদয়ের নদী হয় চিরশুষ্ক।

স্পিচ থেরাপি হল নিঃশব্দ প্রাণে শব্দ ফেরানোর এক আশ্চর্য জাদু। এটি শুধু কথা শেখায় না, শেখায় নিজেকে প্রকাশ করতে, বোঝাতে, ভালোবাসতে। যারা মুখে শব্দ আনতে পারে না, তাদের জন্য থেরাপি হয় আলো জ্বালানোর মশাল। প্রতিটি অনুশীলন যেন জড়তা কাটিয়ে সাহস খুঁজে পাওয়ার এক নতুন সকাল। এটি এক ভাষাহীন পাখিকে ডানার ভাষা শেখায়, যে পাখি উড়তে শেখে আবেগের আকাশে। স্পিচ থেরাপি মানে শব্দের নদীতে প্রথম সাঁতার, যেখানে প্রত্যেকটা উচ্চারণ হয় এক নতুন আশার ঢেউ। এটি নিঃশব্দ মনকে দেয় কণ্ঠস্বরের মুক্তি।

তেমন আশ্চর্য এক যাদুকর সাবরিনা হোসেন তৃষা। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) অবস্থিত সিআরপি ময়মনসিংহ সেন্টারের স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে এক নারীর মুখে ভাষা ফেরানোর গল্প শুনিয়েছেন এবং সমাজে এর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন তৃষা।

৩৫ বছরের নারী সুমি। এক সময় যার মুখভর্তি ছিল শব্দের কাব্য, হাসির রেশ আর জীবনের স্বাভাবিক সুর। হঠাৎ করেই এক রাতে হারিয়ে ফেলেছিলেন সব কিছু। ঘুমন্ত অবস্থায় তার বাড়িতে নেমে আসে হায়েনার মতো একদল সন্ত্রাসী। অন্ধকারের সেই রাতের চিৎকার, ধাক্কাধাক্কি আর নির্মম আঘাতের মধ্য থেকে উঠে এসেছিল এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা- সুমি মাথায় মারাত্মক আঘাত পান। কিন্তু সে আঘাত ছিল শুধু শরীরের উপর নয়, ছিল তার জীবনের মূল অভিব্যক্তির উপর, বাকশক্তির উপর।

সেই রাতের পর সুমি আর আগের সুমি ছিলেন না। ভাষার রঙিন পরিধি থেকে এক ধাক্কায় ছিটকে পড়ে যান নিঃশব্দতার অতলে। চিকিৎসা বিজ্ঞান ভাষায় তার অবস্থা ছিল গ্লোবাল অ্যাফেসিয়া, ওরো-ফ্যারিঞ্জয়াল ডিসফ্যাজিয়া, এবং ডিসলেক্সিয়া যার অর্থ, তিনি আর কথাও বলতে পারতেন না, গিলতে পারতেন না, এমনকি নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতেও পারতেন না।

যখন তিনি কিছু খাওয়ার চেষ্টা করতেন, তখনই শ্বাসরোধ হতো, বমি আসত, কিংবা গলায় আটকে যেত খাদ্য। কথার মতো সাধারণ একটি কাজ হয়ে উঠেছিল ভয়াবহ অভিশাপ। জীবন যেন ক্রমেই একটি নিঃশব্দ, নিঃস্ব, নিঃসহায় বন্দিশালায় রূপ নিয়েছিল।

নিউরো-সার্জনের শীতল উচ্চারণ, “তুমি আর কখনো কথা বলতে পারবে না।” সে যেন ছিল তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক রায়। মনে হয়েছিল, চারপাশে অন্ধকার। আকাশটা যেন তার উপরেই ধসে পড়েছে।

তবু সুমি হাল ছাড়েননি। আলোর ক্ষীণ রেখার মতো, আশার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত সিআরপি ময়মনসিংহ সেন্টারের স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট সাবরিনা হোসেন তৃষা। তিনি শুধুমাত্র চিকিৎসক ছিলেন না, ছিলেন সুমির নিঃশব্দ জীবনের কণ্ঠস্বর ফেরত দেয়ার যোদ্ধা।

সাবরিনার তত্ত্বাবধানে শুরু হয় স্পিচ থেরাপি। ধৈর্য, নিষ্ঠা ও পেশাগত ভালোবাসা নিয়ে তিনি চালিয়ে যেতে থাকেন থেরাপিউটিক প্রটোকলগুলো। সময় লেগেছে মাত্র ১২টি সেশন এবং তিন মাস। আর সেই তিন মাসেই ঘটেছিল বিস্ময়কর এক পরিবর্তন। সুমি আবার মুখে শব্দ তুললেন। প্রথমে ছোট্ট শব্দ, তারপর বাক্য, তারপর গল্প। প্রতিটি উচ্চারণ যেন ছিল জীবনের এক একটি বিজয়োল্লাস।

সাবরিনা বলেন, “আমি এই পেশাটি বেছে নিয়েছি কারণ এটি অনন্য এবং নতুন। আমি মনে করি, একজন অনুসন্ধানপ্রবণ ব্যক্তি হিসেবে আমার দক্ষতা এই পেশার জন্য উপযুক্ত। আমি এতে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারি।”

তিনি আরও বলেন, “স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি বাংলাদেশে এখনও অনেকটাই অজানা একটি ক্ষেত্র। অথচ আমরা যে সমস্যাগুলোর চিকিৎসা করি- কথা বলা, গিলতে পারা, কণ্ঠস্বর, তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। দ্রুত থেরাপি শুরু করলে রোগী দ্রুত উন্নতি লাভ করেন।”

সুমির ফিরে আসা কেবল একটি ব্যক্তিগত পুনর্জন্মের গল্প নয়, বরং এটি একটি অনুপ্রেরণার প্রতীক। তার জীবনের ছায়াঘেরা অধ্যায়ে স্পিচ থেরাপি হয়ে উঠেছে এক রৌদ্রজ্বল প্রভাত। তার কণ্ঠস্বর ফিরে পাওয়া যেন নিঃশব্দ পৃথিবীর মাঝে গান ফেরার মতো, এক নতুন জীবনের সূচনা।

এই গল্প আমাদের শেখায়, নিরবতা কখনোই চিরস্থায়ী নয়। সঠিক চিকিৎসা, যত্ন এবং বিশ্বাস থাকলে যে কেউ ফিরে পেতে পারে নিজের হারিয়ে যাওয়া ‘শব্দজগৎ’। এবং সেই ফেরানোর নেপথ্যে যারা থাকেন, তারা নিঃসন্দেহে সমাজের নীরব নায়ক।

সুমির গল্প আজ বাংলাদেশের বহু গ্লোবাল অ্যাফেসিয়া, ডিসফ্যাজিয়া কিংবা ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের আশার আলো হয়ে উঠতে পারে। হয়তো এই গল্পই অনেককে উদ্বুদ্ধ করবে সময়মতো চিকিৎসা নিতে, কিংবা এই পেশায় যুক্ত হয়ে সমাজে বাকহীনদের কণ্ঠস্বর ফেরাতে।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top