জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান:
২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট—তারিখটি হয়তো ক্যালেন্ডারে নিছক আরেকটি দিন, কিন্তু মিশরের ইতিহাসে এটি খোদাই হয়ে আছে কালো অক্ষরে। কায়রোর রাবা আল-আদাওয়িয়া স্কয়ার সেদিন ভোরে ছিল মানুষের ভিড়ে, উজ্জ্বল প্রত্যাশায় আর শান্তিপূর্ণ দাবির মিছিলে পূর্ণ। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোর্সির পদচ্যুতির পর টানা ছয় সপ্তাহ ধরে সেখানে অবস্থান করছিলেন তাঁর সমর্থকরা। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, এই গণপ্রতিবাদ হয়তো আবার ফিরিয়ে আনবে ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার, ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। কিন্তু সূর্য ওঠার পর অল্প সময়েই শান্তির পতাকা রঞ্জিত হয়ে গেল রক্তে, আর স্কয়ার পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, সাঁজোয়া যান, ভারী অস্ত্র, এবং স্নাইপারদের নিয়ে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে মুহূর্তের মধ্যে গুলি চালাতে শুরু করল নিরস্ত্র মানুষের ওপর। সেই সকালের বাতাস কাঁপছিল ক্রন্দনে, আহতের আর্তনাদে, আর ভয়ের সেই শীতল স্রোতে যা প্রতিটি বুক কাঁপিয়ে তুলছিল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে, শুধু রাবা স্কয়ারেই কমপক্ষে ৮১৭ জন নিহত হন, বহু প্রত্যক্ষদর্শী বলছেন, সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। কাছাকাছি নিজাতাহ স্কয়ারেও একই রকম হত্যাযজ্ঞ চলছিল, লাশের সারি আর রক্তে ভিজে যাওয়া রাস্তাগুলো হয়ে উঠেছিল নীরব সাক্ষী।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই ঘটনাকে আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা আখ্যা দিয়ে বলেছে, এটি ছিল পরিকল্পিত, সুসংগঠিত এবং রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট হত্যাযজ্ঞ—যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শামিল। কিন্তু এই নৃশংসতার এক দশক পেরিয়ে গেলেও কোনো বিচার হয়নি, দায়ীদের একজনও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ায়নি। বরং রাবার সেই দিন যেন বৈধতা দিয়েছে রাষ্ট্রীয় দমননীতিকে, তৈরি করেছে ভয় ও নীরবতার সংস্কৃতি।
রাবা গণহত্যা মিশরের জন্য কেবল একটি দিনের স্মৃতি নয়—এটি এক প্রজন্মের মনে খোদাই হয়ে যাওয়া ভয়, ক্ষোভ ও অবিচারের প্রতীক। এর পরবর্তী বছরগুলোতে দেশজুড়ে শুরু হয় ভয়াবহ দমনপীড়ন—গণগ্রেপ্তার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন, এবং সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ। আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই দশ বছরকে আখ্যা দিয়েছে “অপরাধহীনতার দশ”—যেখানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে জেল, গুম, অথবা মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া।
লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর