রবিউল ইসলাম বাবুল, রংপুর প্রতিনিধিঃ
লালমনিরহাটের আদিতমারী সাবরেজিস্টার অফিসে চলছে দুর্নীতি-অনিয়মের মহোৎসব। সাধারণ মানুষের কাঙ্ক্ষিত সরকারি সেবা যেন সেখানে পরিণত হয়েছে ঘুষ ও হয়রানির থাবায়।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, আদিতমারী সাব-রেজিস্টার অফিসে জমি-জমা সংক্রান্ত যে কোনো কাজ করতে গেলে নির্ধারিত ফি’র বাইরে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয় সেবাগ্রহীতাদের। আর এ প্রক্রিয়ায় যাঁরা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান, তাঁদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে দিনের পর দিন। প্রশাসন এসব বিষয়ে নীরব থেকে যেন এক অদৃশ্য সমর্থনের ভূমিকাই পালন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন শত শত সেবাগ্রহীতা জমি সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের জন্য আদিতমারী সাবরেজিস্টার অফিসে আসেন। কিন্তু অফিসে প্রবেশ করার পর থেকেই শুরু হয় টেবিল থেকে টেবিল ঘোরার খেলা। নির্ধারিত ফি জমা দেওয়ার পরও নানা অজুহাতে ফাইল আটকে রাখা হয়। কাজ সম্পন্ন করতে চাইলে কর্মচারীদের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়। এটি যেন এখানকার একটি ওপেন সিক্রেট, যার বাইরে কোনো কাজ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
এদিকে আদিতমারী সাবরেজিস্টার অফিসে সাব-রেজিস্টার বসেন সপ্তাহে রবিবার ও সোমবার ২দিন। ফলে আদিতমারী উপজেলার ৮ ইউনিয়নের জমি ক্রেতা বিক্রেতাদের পরতে হয় নানামুখী সমস্যায়। জমির দলিল পার করতে রাত ১০ টা অবধি অপেক্ষা করে। তাও আবার লেট ফি বাবদ অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়,যেটি সম্পূর্ণ বেআইনি। এদিকে ২০-৩০ কিঃমিঃ দুর থেকে সাধারণ মানুষ জমি ক্রয় বিক্রির জন্য আদিতমারী সাব-রেজিস্টার অফিসে আসেন, রাত হলে টাকা পয়সা নিয়ে বাড়ী ফেরার পথে প্রাণ নাশের ঝুঁকি থাকে শতভাগ। যেহেতু সরকারের রাজস্ব আয়ের বড় একটি উৎস হচ্ছে এই দপ্তর। তাই অতি দ্রুত সরকারের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের এ দপ্তরের সকল কার্যকলাপে নজরদারী বাড়ানো জরুরী প্রয়োজন বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীগন।
স্থানীয় একজন ভুক্তভোগী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার জমির রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করার পরও আমাকে আরও কয়েক হাজার টাকা দিতে হয়েছে। টাকা না দিলে জমির দলিল পার হয়না। তাই বাধ্য হয়ে ঘুষ দিয়েছি, নাহলে কাজ হতো না।” একই অভিজ্ঞতার কথা জানান দুর্জগাপুর থেকে আসা একজন ক্রেতা । তাঁর ভাষায়, “সাবরেজিস্টার অফিস এখন মানুষের দুর্ভোগের জায়গা। টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না।”
সচেতন মহল বলছেন, সাবরেজিস্টার অফিস একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান। জনগণের ন্যায্য সেবা নিশ্চিত করার জায়গায় এটি। দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁদের অভিযোগ,দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের নীরব ভূমিকা এ অনিয়মকে আরও উৎসাহিত করছে। প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গোপন যোগসাজশের অভিযোগও শোনা যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে এক সমাজকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা ঘুষের মাধ্যমে হাতবদল হচ্ছে। অথচ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এটা শুধু অনিয়ম নয়, এটা রাষ্ট্রীয় সেবাকে ধ্বংস করার এক জঘন্য ষড়যন্ত্র।”
অভিযোগ রয়েছে, সাবরেজিস্টার অফিসে ঘুষ ছাড়া কাগজপত্র যাচাই থেকে শুরু করে দলিল হস্তান্তর,জমির নকল উঠানো,নাম ও দাগ খতিয়ান সার্চ বাবদ প্রয়োজনের অধিক টাকা দিতে হয়, তা-না হলে কাজ হয় না। এদিকে সাব-রেজিস্টার অফিসে হাতে গোনা কিছু নকল নবিস তাদের ইচ্ছে মতো টাকা নিচ্ছেন। টাকা না দিলে আজ কাল করে ভুক্তভোগীকে নাস্তানাবুদ করেন। ফলে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে তারা টাকা দিচ্ছেন। জানা যায়, হাতে গোনা ২/৩ জন নকল নবিস এ হেন অপরাধ মূলক কাজ করে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছেন ভয়ে তাদের কে কেউ কিছু বলে না ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জমির নকল নিতে আসা ব্যাক্তি বলেন, একটি জমির নকল উঠাতে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা দিতে হয়। শুধু তাই নয় জমি সংক্রান্ত যেকোনো কাজে কেউ আসলে মোটা টাকা না দিলে কাজ করেন না সাব-রেজিস্টার অফিসের লোকজন । যাঁরাই দুর্নীতির বিরোধিতা করেন, তাঁদের কাজ ইচ্ছাকৃত জটিলতা তৈরি করে আদিতমারী সাব-রেজিস্টার অফিসের কযেকজন। সুবিধা নিতে আসা সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে টাকাও দিচ্ছে এবং য়ে অন্যায় মেনে নিচ্ছেন।
আদিতমারী সাবরেজিস্টার অফিসে সপ্তাহে দুদিন দলিলের কাজ হওয়ায় অফিসে প্রচন্ড ভীড় থাকে ফলে নানা জটিলতা দেখা গেছে সাব-রেজিস্টার অফিসে। বিকেল ৪ টার পরে সেবা গ্রহিতাদের নিকট অতিরিক্ত অর্থ বা ফি গ্রহন করা হয়ে থাকে। কেউ কিছু বললে সে দলিল পার হয়না। আর যারা কথা না বলে টাকা দেন তাদের কাজ হয় দ্রুত। তাই সাধারণ মানুষের দাবি আদিতমারী সাবরেজিস্টার অফিস সপ্তাহে প্রতিদিন যেন অফিস হয়। তাহলে দূর দূরান্ত থেকে আসা জমি ক্রেতা বিক্রেতাদের আর কোনো অসুবিধা থাকবেনা। অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে না। রাতে দলিল পার কররার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। সঙ্কা ভয় কেটে যাবে। টাকা পয়সা নিয়ে সঠিক সময়ে বাড়ী ফিরতে পারবে। সাধারণ মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসবে। দালাল চক্র নির্মূল হবে। ঘুষ দুর্নীতি কমে যাবে। আদিতমারী উপজেলার মানুষের প্রাণের দাবী, দুর্নীতির সকল উৎস বন্ধে সপ্তাহে পাঁচদিন যেন অফিস কার্যক্রম চলমান থাকে এমনটি প্রত্যাশা তাদের সকলের।
আদিতমারী উপজেলার সূশীল সমাজ ও ভুক্তভোগীদের দাবি আদিতমারী সাবরেজিস্টার অফিস যেন প্রতিদিন সাব-রেজিস্টার বসে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে। সকল ঘুষ দুর্নীতি যাতে বন্ধ হয়। সাধারণ মানুষ যাতে সকল সেবা পায় সেজন্য জেলা প্রশাসক ও সাব- রেজিস্টার অফিস সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কৃপাদৃষ্টি কামনা করছেন।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। তাঁদের মতে, যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে জনগণের আস্থা পুরোপুরি হারাবে সরকারী এই সেবাখাত।
অন্যদিকে আদিতমারী উপজেলার সাব-রেজিস্টারের নীরব ভূমিকা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানুষের বক্তব্য—”যদি সত্যিই তিনি জনগণের সেবক হয়, তবে এই দুর্নীতির চক্র ভেঙে দোষীদের আইনের আওতায় আনা জরুরী বলে মনে করছেন তারা।
এব্যপারে লালমনিরহাট জেলা সাব-রেজিস্টার সঙ্গে মুঠোফোন আলোচনা হলে তিনি সাংবাদিককে বলেন, দুর্নীতি করলে ছাড় নেই, অতিরিক্ত অর্থ আদায় ,সেবা গ্রহিতাদের হয়রানী, দলীল মূল্যের অতিরিক্ত টাকা গ্রহন এটি সম্পূর্ণ বেআইনি কার্যকলাপ। তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে আদিতমারী উপজেলার সচেতন নাগরিকেরা বলেন, প্রশাসন যদি এখনই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তবে এই অনিয়ম আরও গভীরভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে। এ জন্য তাঁরা অবিলম্বে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জেলা প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ উদ্যোগে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।