১০ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৮ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

ভালোবাসা দিলে মানুষ মরে যায় : মনস্তাত্ত্বিক, সাহিত্যিক ও সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ

ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ:

ভালোবাসা দিলে মানুষ মরে যায় এই চরম বাক্যটি প্রেমের এক অন্ধকার দিককে উন্মোচন করে। ভালোবাসা সাধারণত জীবনের আনন্দ, সৃষ্টির প্রেরণা এবং আত্মার আশ্রয় হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু মনস্তত্ত্ব, সাহিত্য ও সমাজতত্ত্বের আলোকে দেখা যায়, অনিয়ন্ত্রিত বা বিকৃত ভালোবাসা ধীরে ধীরে মানুষের ভেতরকে গ্রাস করতে পারে।

সাহিত্য সমালোচনা

ভালোবাসা এক দ্বিধাবিভক্ত সত্য। একদিকে তা জীবনের সঞ্জীবনী সুধা, অন্যদিকে তা এক বিষাক্ত মায়াজাল, যা ধীরে ধীরে মানুষের অস্তিত্বকে গ্রাস করে। প্রচলিত ধারণা হলো, ভালোবাসা জীবনকে পূর্ণতা দেয়, কিন্তু ইতিহাসের পাতা ও সাহিত্যের গভীরে ডুব দিলে এক ভিন্ন চিত্র সামনে আসে,যেখানে ভালোবাসা জীবনের নয়, বরং মৃত্যুরই কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাহিত্যের কালজয়ী চরিত্রগুলো ভালোবাসার এই ধ্বংসাত্মক দিকটির জীবন্ত উদাহরণ। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের অমর সৃষ্টি “রোমিও অ‍্যান্ড জুলিয়েট”-এর কথা ভাবুন। তাদের প্রেম ছিল পবিত্র এবং তীব্র, যা দুটি ভিন্ন পরিবারের বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ছিল। কিন্তু সেই গভীর প্রেমই তাদের করুণ মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভালোবাসা এখানে কোনো মধুর মিলন ঘটায়নি, বরং এক ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে এনেছিল। একইভাবে, লিও টলস্টয়ের মহাকাব্যিক উপন্যাস “আনা কারেনিনা”-তে আনার সমাজের বাঁধন ছিঁড়ে তার প্রেমিক ভ্রনস্কির প্রতি ভালোবাসা তাকে শেষ পর্যন্ত একাকীত্ব এবং হতাশার গভীরে নিমজ্জিত করে, যার একমাত্র পরিণতি হয় আত্মহত্যা। ভালোবাসা এখানে মুক্তির পরিবর্তে এক যন্ত্রণাদায়ক ফাঁদে পরিণত হয়েছিল। কেবল পশ্চিমা সাহিত্যেই নয়, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস-এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? পারুর প্রতি তার ভালোবাসা ছিল এক অবিনাশী টান, যা তার জীবনের সবটুকু জুড়ে ছিল। কিন্তু সেই ভালোবাসা যখন পূর্ণতা পেল না, তখন তা দেবদাসের জীবনকে এক সীমাহীন বিষণ্ণতার দিকে ঠেলে দিল। তার মদ্যপান, আত্ম-ধ্বংসের পথ এবং শেষ পর্যন্ত অকালমৃত্যু প্রমাণ করে যে, ভালোবাসা যখন কোনো কারণে অপূর্ণ থাকে, তখন তা মানুষের অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এটি নিছক একটি আবেগ নয়, বরং এক মারণাস্ত্র, যা মানুষের মন এবং শরীরকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দেয়।

মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সুস্থ সম্পর্কের মূল হলো boundaries বা সুস্পষ্ট সীমানা। এরিখ ফ্রম (The Art of Loving) ভালোবাসাকে একটি দক্ষতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, প্রেমের মধ্যে যত্ন, দায়িত্ব, সম্মান ও জ্ঞান থাকা দরকার; এগুলো না থাকলে প্রেম পরিণত হয় নির্ভরতায় বা দখলদারিতে, যা মানসিক ক্ষয় ডেকে আনে। ফ্রয়েড প্রেমের মধ্যে অবচেতন আকাঙ্ক্ষার ভূমিকা দেখিয়েছিলেন। অতিরিক্ত দমন বা তীব্র আকাঙ্ক্ষার সংঘাত বিষণ্নতা বা আত্মবিনাশে পৌঁছাতে পারে। “Emotional dependency syndrome”-এ দেখা যায়, প্রিয়জনকে হারানোর ভয় এত তীব্র হয় যে মানুষ আত্মসম্মান ভুলে নিঃশেষিত হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, “ভালোবাসা দিলে মানুষ মরে যায়” আসলে সেই মানসিক মৃত্যু বোঝায়, যা ঘটে যখন ভালোবাসা যুক্তি ও আত্মসম্মানের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। ভালোবাসা কেন মৃত্যুর কারণ হয়, তা বোঝার জন্য দর্শন এবং মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা প্রয়োজন। মনোবিজ্ঞানে ‘কোডিপেন্ডেন্সি’ বলে একটি ধারণা আছে, যেখানে একজন ব্যক্তি অন্যজনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যে সে নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলে। ভালোবাসা যখন এই পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন তা আর সুস্থ থাকে না। এরিস্টটল বলেছিলেন, “ভালোবাসা দুটি দেহের একটি আত্মা।” কিন্তু এই আত্মা যখন এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে, একজনের সত্তা সম্পূর্ণভাবে অন্যজনের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়, তখন সেই ব্যক্তি তার নিজস্ব পরিচয় হারিয়ে ফেলে। যখন সেই ভালোবাসা আর থাকে না, তখন সেই ব্যক্তি নিজেকে শূন্য এবং অর্থহীন মনে করে।

সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ

সমাজতত্ত্ব দেখায় যে ভালোবাসা কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, সামাজিক কাঠামো ও সাংস্কৃতিক প্রত্যাশার সাথেও গভীরভাবে যুক্ত। অ্যান্থনি গিডেন্স তাঁর The Transformation of Intimacy-তে বলেছেন, আধুনিক সমাজে সম্পর্কগুলো “pure relationship” আকারে গড়ে ওঠে, যেখানে আবেগের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই প্রত্যাশা মানুষকে মানসিকভাবে বিপন্ন করে তুলতে পারে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে প্রেমের নামে দখলদারি, হিংসা, এমনকি নারী নির্যাতনও দেখা যায়। সংবাদে প্রায়শই “প্রেমঘটিত আত্মহত্যা” বা “অনার কিলিং”-এর খবর আসে।

গ্লোবালাইজড সংস্কৃতিতে সিনেমা, গান ও সামাজিক মাধ্যম প্রেমকে চূড়ান্ত তীব্রতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে; ফলে তরুণ-তরুণীরা প্রায়ই মনে করে, ভালোবাসার জন্য বেঁচে থাকা বা মরাই একমাত্র বিকল্প। মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিতে অতিরিক্ত আসক্তি ও নির্ভরতা মানসিক মৃত্যু ডেকে আনে; সাহিত্যে প্রেম প্রায়ই ধ্বংসের প্রতীকে রূপ নেয়; আর সমাজতত্ত্ব জানায়, প্রেমের সাংস্কৃতিক প্রত্যাশা অনেক সময় মানুষকে আত্মবিনাশী করে তোলে।

তবু ভালোবাসার সুস্থ রূপের শক্তি অপরিসীম। কার্ল ইয়ুং লিখেছিলেন, প্রেম হলো আত্মার বিকাশের উপায়, কিন্তু তা সচেতনতার আলোয় নিয়ন্ত্রিত না হলে নিজের ছায়াকে সামনে আনে। অতএব, ভালোবাসা দিলে মানুষ মরে যায় কথাটি আমাদের সতর্ক করে,প্রেমের শক্তিকে অবহেলা করলে তা ধ্বংসে পরিণত হতে পারে। সচেতনতা, সম্মান ও ভারসাম্যই ভালোবাসাকে জীবনের পক্ষে রূপান্তরিত করে, মৃত্যুর নয়।ভালোবাসা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং এক অদম্য শক্তি। কিন্তু যখন এই শক্তি সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না, তখন তা ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভালোবাসা যখন জীবনের সব লক্ষ্য, স্বপ্ন এবং ব্যক্তিগত পরিচয়কে ছাপিয়ে যায়, তখন তা জীবনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ভালোবাসা যখন একটি নেশায় পরিণত হয়, তখন তা আর জীবনদায়ী থাকে না। পরিশেষে বলা যায়, ভালোবাসা জীবনের এক অপরিহার্য অংশ, কিন্তু তার একটি অন্ধকার দিকও আছে। তা হলো, যখন ভালোবাসা মানুষের অস্তিত্বকে গ্রাস করে নেয়। সাহিত্যে এবং জীবনে এমন অনেক উদাহরণ আছে যা প্রমাণ করে যে, ভালোবাসা যখন অতিরিক্ত আবেগ, অপূর্ণতা এবং নির্ভরশীলতার সাথে মিশে যায়, তখন তা এক মরণফাঁদ হয়ে দেখা দেয়। তাই ভালোবাসা যেন জীবনকে পূর্ণ করে, জীবনের সবটুকু গ্রাস না করে।

সমাপ্ত

কবি ও গল্পকার

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top