১৯শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৭শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

ভারত হয়ে তৃতীয় দেশে ইলিশ পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস, বন্ধ রপ্তানি

নিজস্ব প্রতিনিধি:

বাংলাদেশ থেকে প্রতি কেজি ইলিশ ১৯০০ থেকে ২ হাজার টাকায় কিনে ভারতে পাঠাতে মোট খরচ দাঁড়ায় ২১০০ থেকে ২২০০ টাকা, যা ডলারে প্রায় ২০ থেকে ২১ ডলার। এতে লোকসান হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। অথচ পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেই একই ইলিশ বিভিন্ন দেশে পুনঃরপ্তানি হয়ে বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৪৫ ডলারে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে লাভ দাঁড়ায় ২০ থেকে ২৪ ডলার বা প্রায় ২৮০০ টাকা। পুরো প্রক্রিয়ায় সহায়তা করছে পশ্চিমবঙ্গের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।

গত সোমবার দেশের একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ভারতকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করে ইলিশ পাচারের বিস্তারিত সংবাদ। এরপর থেকেই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ইলিশ রপ্তানি।

বেনাপোল ফিশ কোয়ারেন্টাইন কর্মকর্তা আকসাদুল ইসলাম জানিয়েছেন, রবিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত বৈধভাবে এক কেজি ইলিশও সীমান্ত পার হয়নি। বেনাপোল স্থলবন্দরের এক কর্মকর্তা জানান, রপ্তানির জন্য ইলিশ বোঝাই দুটি ট্রাক বন্দরে এলে রহস্যজনক কারণে সিদ্ধান্ত বদলে সেগুলো ফেরত পাঠানো হয়।

সরকার এবার দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ভারতে ১ হাজার ২০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছিল। প্রতি কেজির রপ্তানি মূল্য ধরা হয়েছিল সাড়ে বারো ডলার বা ১ হাজার ৫২৫ টাকা। কিন্তু দেশের বাজারে তখন ইলিশের দাম ছিল কেজিপ্রতি ১৮০০ টাকা। বরফ, প্যাকেজিং ও পরিবহন খরচসহ ভারতে পৌঁছাতে খরচ দাঁড়ায় ২ হাজার টাকার বেশি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে এই ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২২০০ টাকা পর্যন্ত। এভাবে লোকসানে কেন রপ্তানি হচ্ছে তা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। খোঁজ নিতে গিয়েই বেরিয়ে আসে ভারত হয়ে তৃতীয় দেশে ইলিশ পাচারের কাহিনি।

কলকাতার একাধিক মাছ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, বহু বছর ধরেই বাংলাদেশি ইলিশ এভাবে পাচার হয়ে আসছে। চোরাই পথে পশ্চিমবঙ্গে আনা ইলিশ হিমায়িত করে বিভিন্ন দেশে পুনঃরপ্তানি করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের বাজারে বিক্রি হয় সামান্যই।

জানা যায়, বাংলাদেশের অন্তত চারজন রপ্তানিকারকের কলকাতার হাওড়া, বশিরহাট ও বারাসাতে আড়ত ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে নীরব হোসেন টুটুল চারটি লাইসেন্সে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি পান। তার শ্বশুরবাড়ি কলকাতার বশিরহাটে। আরও কয়েকজন রপ্তানিকারক সেভেন স্টার ফিশ প্রসেসিং করপোরেশন ও কেবিসিসহ টুটুলের সঙ্গে ব্যবসা করছেন। কলকাতার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতাদের সহযোগিতায় আত্মীয়স্বজনের নামে ভারতীয় রপ্তানিকারকের লাইসেন্স নিয়ে ইলিশ পাচার হচ্ছে।

প্রমাণ মিলেছে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার কয়েকজন বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ মালিকের কাছ থেকেও। তারা জানিয়েছেন, পদ্মার ইলিশ ভারত হয়ে এসব দেশে পৌঁছায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে চুক্তি হয়।

দেশের একটি জাতীয় পত্রিকায় অনুসন্ধান প্রকাশের পর হঠাৎ করেই রপ্তানির জন্য পাঠানো ইলিশ ফেরত আনা হয়। সেভেন স্টার ফিশ প্রসেসিং করপোরেশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ক্রয়মূল্যের চেয়ে রপ্তানি মূল্য কম হওয়ায় যশোরের বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। তবে কেন সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে ফেরত আনা হলো—এর সন্তোষজনক জবাব তারা দিতে পারেনি।

বাংলাদেশ ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নিজামউদ্দিন বলেন, ক্রেতা নিশ্চিত হওয়ার পরেই রপ্তানিকারকরা মাছ সংগ্রহ করেন। বন্দরে পৌঁছে ফেরত আনার পেছনে নিশ্চয় অন্য কারণ আছে। বিষয়টি সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত।

বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি এবায়েদুল হক চান জানান, বহু বছর ধরে একটি বড় সিন্ডিকেট ভারত হয়ে ইলিশ পাচার করছে। বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় এখন রপ্তানি বন্ধ করে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আনোয়ার মকসুদ অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের ইলিশের দাম বেশি হওয়ায় আমদানি করে লাভ হয় না। তবে প্রথম দুদিনে ৭ হাজার কেজি ইলিশ আমদানি হওয়ার পর হঠাৎ করে কেন লোকসানের কথা বলা হচ্ছে তার সঠিক ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top