মো. সাইফুল ইসলাম, নীলফামারী প্রতিনিধি:
উত্তরের সীমান্তবর্তী জনপদ নীলফামারীতে বইছে নির্বাচনি হাওয়া। উন্নয়ন, বঞ্চনা আর রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে মুখর সাধারণ মানুষ। দলগুলো ব্যস্ত তাদের কর্মতৎপরতা ও অর্জনের ফিরিস্তি ভোটারদের সামনে তুলে ধরতে। এরই মধ্যে জেলার চারটি সংসদীয় আসনে জমে উঠেছে নির্বাচনি মাঠ।
তবে প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের জটিলতায় পড়েছে বিএনপি। চারটি আসনের মধ্যে এখনো দুটিতে প্রার্থী ঘোষণা করতে পারেনি দলটি। আবার যেসব আসনে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে, সেখানেও দেখা দিয়েছে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও আন্দোলন। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে হারানো ঘাঁটি পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রচারে নেমেছে জামায়াতে ইসলামী।
জেলার চার আসনেই বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা নিয়মিত মিছিল, পথসভা, গণসংযোগ ও কর্মসূচির মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন। কোথাও কোথাও চলছে শক্তিমত্তার মহড়া। এর পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদসহ অন্যান্য দলও মাঠে সক্রিয় রয়েছে।
নীলফামারী-১ (ডোমার–ডিমলা)
সীমান্তবর্তী দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে অতীতে বিএনপি কখনো জয় পায়নি। জাতীয় পার্টি কিংবা আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই এখানে বিজয়ী হয়েছেন। এবার তাদের অনুপস্থিতিতে আসনটি দখলে মরিয়া বিএনপি ও জামায়াত।
তবে এখনো এ আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা না করায় অনিশ্চয়তা কাটেনি। জোট শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগনে শাহরিন ইসলাম চৌধুরী আলাদা আলাদা ভাবে নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছেন। এই দুই হেভিওয়েট নেতাকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে প্রার্থী জটিলতা। ফলে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেও তেমন উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে জামায়াত অনেক আগেই জেলা আমির অধ্যক্ষ আবদুস সাত্তারকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তিনি ব্যাপক গণসংযোগ ও সংগঠিত প্রচারে পুরো এলাকা ব্যানার-পোস্টারে ভরে তুলেছেন। জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনরত অন্যান্য দলগুলোর সমর্থন পেলে তাকে পরাজিত করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন ভোটারদের একটি অংশ।
নীলফামারী-২ (সদর)
এ আসনটি ঐতিহাসিকভাবে জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। অতীতে আওয়ামী লীগকে এখানে বারবার জামায়াত প্রার্থীর সঙ্গে কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় পুরোনো অবস্থান পুনরুদ্ধারে তৎপর জামায়াত।
জামায়াত প্রার্থী করেছে জেলা বারের সভাপতি ও সহকারী সেক্রেটারি আল ফারুক আবদুল লতিফকে। আওয়ামী আমলে মামলা-হামলার শিকার হওয়া এই নেতার এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে বলে দাবি নেতাকর্মীদের।
বিএনপি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে জেলা সদস্য সচিব এএইচএম সাইফুল্লাহ রুবেলকে। তবে তাকে মনোনয়ন দেওয়ায় দলের ভেতর অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। স্থানীয় অনেক নেতাকর্মীর মতে, দীর্ঘদিন সাংগঠনিকভাবে দুর্বল এ আসনটি গড়ে তুলেছিলেন প্রবাসী নেতা ও সাবেক জেলা সেক্রেটারি শামসুজ্জামান জামান। তাকে বাদ দেওয়ায় ভোটের মাঠে বিএনপি পিছিয়ে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন তারা।
এ আসনে এনসিপির প্রার্থী ডা. কামরুল ইসলাম দর্পনও প্রচারে সক্রিয়। ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য দলও নিজেদের অবস্থান জোরদারে কাজ করছে।
নীলফামারী-৩ (জলঢাকা)
একক উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনটি জামায়াতের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি। অতীতে তিনটি সংসদে জামায়াতের এমপি ছিলেন এখান থেকে। এবার দলটি প্রার্থী করেছে জেলা শূরা সদস্য ওবায়দুল্লাহ সালাফীকে।
তিনি ইউনিয়নভিত্তিক উঠান বৈঠক, সভা ও সেমিনারের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন। দলীয় গণ্ডির বাইরে সাধারণ ভোটারদের কাছেও পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন তিনি।
এ আসনে বিএনপি এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। জোটের শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির কারণে সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে বলে জানা গেছে। তবে সাবেক জেলা সহসভাপতি ও দুবারের উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ আলী মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। তিনি কেন্দ্র থেকে ইতিবাচক সংকেত পেয়েছেন বলেও দাবি করছেন।
নীলফামারী-৪ (সৈয়দপুর–কিশোরগঞ্জ)
এই আসনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সৈয়দপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি অধ্যক্ষ আবদুল গফুরের নাম। ঘোষণার পরপরই দলটির নেতাকর্মীদের একাংশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তার প্রার্থিতা বাতিলের দাবিতে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ মিছিলও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন ও সাবেক এমপি শওকত চৌধুরী। মনোনয়ন না পেয়ে তারা প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানিয়েছেন। শওকত চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন—এমন গুঞ্জনও রয়েছে।
এই বিভাজনের সুযোগ নিচ্ছে জামায়াত। দলটি সৈয়দপুর উপজেলা আমির হাফেজ আবদুল মোনতাকিমকে প্রার্থী করেছে। ধারাবাহিক প্রচারের মাধ্যমে তিনি ভোটারদের কাছ থেকে সাড়া পাচ্ছেন বলে দাবি নেতাকর্মীদের। অবাঙালি অধ্যুষিত এ আসনে বিহারি ভোটের বড় অংশ দাঁড়িপাল্লায় যেতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
এ আসনে এনসিপি প্রার্থী করেছে জুলাইযোদ্ধা আবু সাইদ লিয়নকে। পাশাপাশি সাবেক এমপি সিদ্দিকুল আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন।