নিজস্ব প্রতিনিধি:
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ও সমালোচিত নামগুলোর একটি হয়ে উঠেছেন জুলাইয়ের অগ্রনায়ক ওসমান হাদি। তার বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড যেমন তাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনেছে, তেমনি সৃষ্টি করেছে নানা বিতর্কও।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিভিন্ন রায় নিয়ে সরব ভূমিকা রাখেন ওসমান হাদি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি বিভিন্ন টেলিভিশন টকশো ও আলোচনা অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিয়ে তিনি দ্রুতই পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইনকিলাব মঞ্চ নামে একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম গঠন করে জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করেন হাদি। একই সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে শুরু করেন নির্বাচনী প্রচারণা।
এই প্রচারণার মধ্যেই বন্দুকধারীর গুলিতে গুরুতর আহত হন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি। রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কি এলাকার বক্স কালভার্ট রোডে হামলার শিকার হন তিনি। তফসিল ঘোষণার পরপরই এ হামলার ঘটনা রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগের জন্ম দেয়।
যেভাবে রাজনীতির লাইমলাইটে আসেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা শরীফ ওসমান হাদি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। পাশাপাশি একটি ইংরেজি ভাষা শিক্ষার কোচিং সেন্টারেও তিনি পাঠদান করতেন।
বরিশালের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার বাসিন্দা হাদি শিক্ষাজীবন থেকেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। ঝালকাঠির এন এস কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান এবং সেখান থেকেই তার রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ ঘটে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও দীর্ঘ সময় তিনি কোনো সক্রিয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। মূলত ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানই তাকে রাজনীতির মূল স্রোতে নিয়ে আসে।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন ভূমিকার মাধ্যমে আলোচনায় আসেন হাদি। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ইনকিলাব মঞ্চ গঠন এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে তার দেওয়া বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ এবং ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়েও আলোচনায় থাকেন তিনি।
ইনকিলাব মঞ্চ গঠনের পর জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণ, অপরাধীদের বিচার, আহত ও নিহতদের স্বীকৃতি এবং জুলাই চার্টার ঘোষণার দাবিতে ধারাবাহিক সভা-সমাবেশে অংশ নেন হাদি। এসব কর্মকাণ্ড তাকে জাতীয় রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্য সামনে রেখে ইনকিলাব মঞ্চ থেকে দেওয়া আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি একটি উল্লেখযোগ্য সমর্থকগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
তবে এর ফলেই তিনি প্রতিপক্ষের চক্ষুশূলেও পরিণত হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট ও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি একাধিকবার হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা প্রকাশ করেন।
একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টে তিনি দাবি করেন, দেশি ও বিদেশি অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এমনকি তার বাড়িতে আগুন দেওয়া এবং পরিবারের সদস্যদের ধর্ষণের হুমকির কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
যেসব কারণে বিতর্ক
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি যেমন আলোচনায় ছিলেন, তেমনি নানা বিতর্কের জন্মও দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী রাজনীতিতে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বিএনপি নেতাদের বক্তব্যেরও প্রকাশ্য সমালোচনা করতে দেখা গেছে তাকে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে কিংবা নির্বাচনী প্রচারণার সময় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মুড়ি-বাতাসা বিতরণের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে নতুন করে আলোচনা তৈরি করে।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর তার প্রচারণার কৌশল, রাজনৈতিক ভাষা ও বক্তব্য ঘিরে সমালোচনা দেখা যায়।
ঢাকা-৮ সংসদীয় আসন—মতিঝিল, পল্টন, রমনা ও শাহজাহানপুর এলাকা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে নিয়মিত নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণা চালান হাদি।
প্রচারণাকালে তার বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে এক ভিডিওতে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি তার পকেটে টাকা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন—যা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়।
এ ছাড়া ভোররাতে মসজিদের সামনে লিফলেট বিতরণ, নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ, ডোনেশনের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ এবং প্রচারণার সময় অর্থ গ্রহণের দৃশ্যসহ নানা ভিডিও তিনি নিজেই সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করতেন।
সব মিলিয়ে, রাজনীতিতে ইতিবাচক আলোচনার পাশাপাশি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি এক গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত চরিত্রে পরিণত হয়েছেন।