নিজস্ব প্রতিনিধি:
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় অস্থিরতা ও উদ্বেগের ছায়া ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থান নেওয়া ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে পরিকল্পিত দমন-পীড়নের আশঙ্কা করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে ভারতের একপক্ষীয় নীতি ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে যারা রাজপথ ও লেখনীতে সোচ্চার, তাদের স্তব্ধ করতে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ইঙ্গিত মিলছে বলে দাবি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর।
সম্প্রতি ইনকিলাব মঞ্চের সংগঠক শরীফ ওসমান হাদির ওপর প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিবর্ষণের ঘটনাটি এই আশঙ্কাকে আরও জোরালো করেছে। নিরাপত্তাসংশ্লিষ্টদের মতে, স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে কথা বলা ব্যক্তিরাই এখন একটি নির্দিষ্ট ‘হিটলিস্টে’ রয়েছেন।
বহুমাত্রিক দমন কৌশলের অভিযোগ
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কথিত এই দমন পরিকল্পনা সরাসরি কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে নয়; বরং ছায়া সংগঠন, ভাড়াটে ক্যাডার ও ডিজিটাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। এতে তিনটি ধাপ দেখা যাচ্ছে—প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চরিত্রহনন ও নেতিবাচক তকমা লাগিয়ে জনবিচ্ছিন্ন করা, এরপর গতিবিধি ও অবস্থান নজরদারি, এবং সুযোগ পেলে শারীরিক হামলা বা ডিজিটালভাবে নিষ্ক্রিয় করা।
হাদির ওপর হামলাকে নিরাপত্তা মহলের একটি অংশ কেবল ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, বরং সার্বভৌমত্বপন্থী কণ্ঠগুলোকে ভয় দেখানোর একটি ‘বার্তা’ হিসেবে দেখছে।
‘হাই-রিস্ক’ তালিকায় রাজনীতি ও সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে প্রায় ৫০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একটি তালিকা করা হয়েছে, যাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি সর্বোচ্চ বলে বিবেচিত হচ্ছে। তালিকায় রয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, এবি পার্টির শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ ও মুজিবুর রহমান মঞ্জু।
এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় মুখ ও বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম, এনসিপির আখতার হোসেন, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নূর ও রাশেদ খানসহ একাধিক রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতার নাম রয়েছে তালিকায়।
ধর্মীয় অঙ্গনের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যেও হেফাজতে ইসলামের মাওলানা মামুনুল হক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি রেজাউল করীম এবং কয়েকজন ইসলামি চিন্তাবিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ঝুঁকি ও নজরদারি
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্রনেতাদের একটি বড় অংশ এই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, ক্যাম্পাস ও আশপাশে কিছু ‘স্লিপার সেল’ সক্রিয় রয়েছে, যারা আধিপত্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। কয়েকজন নেতাকে ফোনে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
‘ডিজিটাল হিটলিস্ট’ ও সাইবার নজরদারি
সাইবার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টদের দাবি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কিছু পেজ ও গ্রুপ থেকে নিয়মিতভাবে আধিপত্যবিরোধী ব্যক্তিদের ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি ডার্ক ওয়েবে অবস্থান, ফোন নম্বর ও চলাচলের তথ্য শেয়ার করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। এটিকে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় ইতোমধ্যে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সশস্ত্র এসকর্ট টিম, চলাচলকালীন নজরদারি এবং প্রয়োজনে সেফ হাউস ব্যবহারের সুযোগ। সভা-সমাবেশের আগে সংশ্লিষ্ট এলাকা তল্লাশি ও নিরাপত্তা বলয় নিশ্চিত করা হচ্ছে।
‘টেস্ট কেস’ হিসেবে হাদির ওপর হামলা?
নিরাপত্তা মহলের একটি অংশ মনে করছে, হাদির ওপর হামলাটি ছিল একটি ‘টেস্ট কেস’—রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিক্রিয়া যাচাই করার প্রয়াস। দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত হত্যা, তিস্তা চুক্তি ও আঞ্চলিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে তরুণদের সংগঠিত করছিলেন তিনি। জনসমক্ষে তাকে লক্ষ্য করে হামলাকে অনেকেই একটি ভয় দেখানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন।
সতর্কবার্তা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন কেবল কূটনীতির বিষয় নয়, বরং সরাসরি সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। এই বিষয়ে কণ্ঠ তোলা ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে দেশ একটি ভয়ংকর নীরব সন্ত্রাসের দিকে এগোতে পারে। তারা মনে করেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।
তাদের ভাষায়, আধিপত্যবিরোধী কণ্ঠগুলো আজ ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে, কারণ এসব কণ্ঠই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের চেতনাকে শক্তিশালী করছে—যা কোনো আধিপত্যবাদী শক্তির জন্য সহজে গ্রহণযোগ্য নয়।