নিজস্ব প্রতিনিধি:
দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যা দুই দেশের মধ্যে চলমান কূটনৈতিক উত্তেজনাকে আরও স্পষ্টভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।
মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করার মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দিল্লি বাংলাদেশি দূতকে ডেকে পাঠায়, যা কূটনৈতিক অঙ্গনে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এর আগে একই দিন বাংলাদেশ সরকার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের কূটনৈতিক ও কনস্যুলার এলাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ জানাতে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ভারতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন প্রাঙ্গণ ও এর আশপাশের এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত সহিংস বিক্ষোভ, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিশেষ করে গত শনিবার নয়াদিল্লির কূটনৈতিক এলাকায় বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং হাইকমিশনারের সরকারি বাসভবনের বাইরে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত বিক্ষোভ ও হুমকির ঘটনা এবং পরদিন সোমবার পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে অবস্থিত বাংলাদেশ ভিসা কেন্দ্রে উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর ভাঙচুরের ঘটনায় ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কূটনৈতিক স্থাপনা ও কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা স্বাগতিক দেশের আন্তর্জাতিক দায়িত্বের অংশ, অথচ এসব ঘটনায় সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালিত হয়নি বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে ‘পরিকল্পিত সহিংসতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তীব্র নিন্দা জানায় এবং উল্লেখ করে যে, এ ধরনের ঘটনা কেবল কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মৌলিক নীতিকেও ক্ষুণ্ন করে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সে বিষয়ে ভারত সরকারের কাছ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন আগেই জানিয়েছিলেন, গত শনিবার রাতে নয়াদিল্লির কূটনৈতিক এলাকায় নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেদ করে ‘হিন্দু চরমপন্থি’ একটি দল বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করে এবং ওই সময় হাইকমিশনারকে সরাসরি হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
তার অভিযোগ ছিল, কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত সুরক্ষিত বলে বিবেচিত এলাকায় এ ধরনের বিক্ষোভ ও হুমকি ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতিরই প্রমাণ এবং এ ক্ষেত্রে স্বাগতিক দেশ হিসেবে ভারতের দায়িত্ব পালনে ঘাটতি ছিল। তিনি আরও বলেন, ঘটনার পর থেকে দিল্লিতে অবস্থানরত বাংলাদেশ হাইকমিশনারের পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং বিষয়টি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।
এসব অভিযোগের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে দাবি করে, বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে যে বিক্ষোভ হয়েছে তা মূলত বাংলাদেশের ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কয়েকজন যুবকের স্লোগান দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং সেখানে নিরাপত্তা বেষ্টনি ভাঙা, সহিংসতা বা কূটনৈতিক স্থাপনায় অনুপ্রবেশের কোনো চেষ্টা হয়নি।
ভারতীয় পক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং নিরাপত্তা বাহিনী দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। তবে বাংলাদেশের পক্ষ মনে করছে, বাস্তব পরিস্থিতি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ভারতের বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভকারীদের উপস্থিতি ও হুমকির ঘটনাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব এবং তার প্রতিক্রিয়ায় দিল্লিতে বাংলাদেশি হাইকমিশনারকে তলব করার ঘটনা দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ের উত্তেজনাকেই প্রতিফলিত করছে, যা মূলত নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যু এবং পারস্পরিক আস্থার ঘাটতির সঙ্গে সম্পর্কিত।
তারা মনে করছেন, বাংলাদেশ হাইকমিশনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি যদি দ্রুত ও কার্যকরভাবে সমাধান না করা হয়, তাহলে তা কূটনৈতিক সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন ও ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় স্বাগতিক দেশের ওপর বর্তায় এবং এ বিষয়ে কোনো ধরনের ব্যর্থতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে।
এ অবস্থায় কূটনৈতিক মহল আশা করছে, পাল্টাপাল্টি তলবের মাধ্যমে বার্তা বিনিময়ের পর উভয় দেশই উত্তেজনা কমিয়ে আনতে সংলাপ ও কূটনৈতিক পথে সমাধানের উদ্যোগ নেবে এবং ভবিষ্যতে কূটনৈতিক স্থাপনা ও কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কঠোর ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যাতে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক নতুন কোনো সংকটে না পড়ে।