নিজস্ব প্রতিনিধি:
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও জুলাই আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ শহীদ শরীফ ওসমান বিন হাদি হত্যা মামলায় তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি এসেছে। মামলার প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল দাউদ এবং তার সহযোগীদের নামে থাকা মোট আটটি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ নির্দেশকে তদন্তের ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা, কারণ এর মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের পেছনের আর্থিক যোগসূত্র, অর্থের উৎস এবং সম্ভাব্য মদদদাতাদের চিহ্নিত করার পথ আরও সুগম হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার ২৩ ডিসেম্বর ঢাকার মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের অবকাশকালীন বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন এই আদেশ দেন। আদালতের আদেশ অনুযায়ী, তদন্ত চলাকালে অভিযুক্তদের আর্থিক লেনদেন যাতে গোপন বা স্থানান্তর করা না যায়, সে লক্ষ্যেই ব্যাংক হিসাবগুলো সাময়িকভাবে জব্দ করা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই আদালত এই নির্দেশ প্রদান করেছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, হত্যাকাণ্ডটি শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, বরং এর পেছনে সংগঠিত পরিকল্পনা, আর্থিক লেনদেন এবং একাধিক সহযোগীর সম্পৃক্ততা রয়েছে—এমন ধারণা থেকেই আর্থিক দিকটি গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো। ব্যাংক হিসাব জব্দের মাধ্যমে অভিযুক্তদের আর্থিক গতিবিধি বিশ্লেষণ করে হত্যাকাণ্ডের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে কোনো সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে কি না, তা যাচাই করা হবে।
হাদি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে গত ১২ ডিসেম্বর, জুমার নামাজ শেষে রাজধানীর পল্টন এলাকার বক্স কালভার্ট রোডে। ওই দিন নির্বাচনি প্রচারণা ও গণসংযোগ কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সময় শরীফ ওসমান হাদির ওপর প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা চালানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শী ও তদন্ত সূত্রের বরাতে জানা যায়, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা রাহুল দাউদ ও তার সহযোগীরা চলন্ত অবস্থায় হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে এবং দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। গুলিটি তার মাথায় লাগে, ফলে তিনি গুরুতর আহত হন।
ঘটনার পরপরই স্থানীয় লোকজন ও সহকর্মীদের সহায়তায় হাদিকে মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতাল এভারকেয়ারে স্থানান্তর করা হয়। তবে অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকায় চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সেখানে কয়েকদিন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৮ ডিসেম্বর রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ব্যাপক শোক ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
প্রাথমিকভাবে এই ঘটনায় ১৪ ডিসেম্বর পল্টন থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। তবে শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের ভিত্তিতে মামলায় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা, অর্থাৎ হত্যা মামলা যুক্ত করা হয়। এরপর মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে। তদন্তের শুরু থেকেই ডিবি পুলিশ ঘটনার পেছনের পরিকল্পনা, আসামিদের গতিবিধি এবং তাদের নেটওয়ার্ক চিহ্নিত করতে কাজ করছে।
ডিবি পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে আসামিদের আর্থিক লেনদেনের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে ঘটনার আগে ও পরে কিছু ব্যাংক হিসাবে বড় অঙ্কের লেনদেন হয়েছে কি না, কিংবা কোনো তৃতীয় পক্ষ থেকে অর্থ সহায়তা এসেছে কি না—এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই আদালতের কাছে ব্যাংক হিসাব জব্দের আবেদন জানানো হয়, যাতে তদন্ত চলাকালে কোনো অর্থ স্থানান্তর বা গোপন করার সুযোগ না থাকে।
আদালতের আদেশ অনুযায়ী, জব্দ করা ব্যাংক হিসাবগুলোতে আপাতত কোনো ধরনের লেনদেন করা যাবে না। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অথবা পরবর্তী কোনো নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এসব হিসাব স্থগিত থাকবে। তদন্ত কর্মকর্তারা এসব হিসাবের স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করবেন এবং প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, হত্যা মামলায় ব্যাংক হিসাব জব্দ একটি গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত কৌশল। এর মাধ্যমে অপরাধের পেছনের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট উদঘাটন করা সম্ভব হয়। অনেক সময় দেখা যায়, হত্যাকাণ্ডের আগে ভাড়াটে খুনি বা সহযোগীদের অর্থ প্রদান করা হয়, আবার ঘটনার পর আত্মগোপনে যাওয়ার জন্যও অর্থের প্রয়োজন হয়। এসব লেনদেনের সূত্র ধরেই অনেক সময় মূল পরিকল্পনাকারী বা মদদদাতাদের চিহ্নিত করা যায়।
এদিকে, হাদি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহল থেকে দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি উঠেছে। ইনকিলাব মঞ্চসহ বিভিন্ন ছাত্র ও নাগরিক সংগঠন এই হত্যাকে রাজনৈতিক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে উল্লেখ করে দায়ীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়ে আসছে। তারা বারবার বলছে, এই মামলার বিচার যদি দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন না হয়, তবে তা সমাজে একটি ভয়ংকর বার্তা দেবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংক হিসাব জব্দের পাশাপাশি আসামিদের মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড, ডিজিটাল লেনদেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগ এবং চলাচলের তথ্যও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে ফরেনসিক ও সাইবার বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া হবে। তারা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের পুরো চেইন—পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত—উন্মোচন করাই তদন্তের মূল লক্ষ্য।
হাদি হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, তা শুধু একটি ব্যক্তির মৃত্যুকে ঘিরে নয়, বরং এটি রাষ্ট্রে নিরাপত্তা, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আদালতের নির্দেশে আসামিদের ব্যাংক হিসাব জব্দ হওয়াকে অনেকেই ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, শরীফ ওসমান বিন হাদি হত্যা মামলায় ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ তদন্তকে নতুন গতি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, এই আর্থিক অনুসন্ধান থেকে কী ধরনের তথ্য বেরিয়ে আসে এবং শেষ পর্যন্ত তা মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় কীভাবে প্রভাব ফেলে। দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে, এই আলোচিত হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের দিকে।