২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৪ঠা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নাম বাদের আবেদন খারিজ, নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না মাহমুদুর রহমান মান্না

নিজস্ব প্রতিনিধি:

ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নিজের নাম বাদ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে দায়ের করা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার রিট আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট, যার ফলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার অংশগ্রহণের সুযোগ থাকছে না বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।

বুধবার ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. বজলুর রহমান ও বিচারপতি মো. মনজুর আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে মাহমুদুর রহমান মান্নার পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম এবং ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শফিকুর রহমান।

শুনানি শেষে আদালত রিট আবেদনটি খারিজ করে দিলে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দেয়। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নিজের নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জানিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না যে রিট করেছিলেন, আদালত সেটি খারিজ করেছেন।

এর ফলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী তিনি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য অনুযায়ী, সংবিধান ও নির্বাচন আইন অনুসারে কোনো ব্যক্তি যদি ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকেন এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেই ঋণ পরিশোধ না করেন, তাহলে তার নির্বাচনে অংশগ্রহণের আইনগত যোগ্যতা থাকে না।

অন্যদিকে মাহমুদুর রহমান মান্নার আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, হাইকোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে তারা আপিল বিভাগে আবেদন করবেন এবং সেখানেই পরবর্তী আইনি লড়াই চালানো হবে।

এই মামলার পেছনের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত ১০ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের বগুড়া বড়গোলা শাখা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান আফাকু কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের কাছে খেলাপি অর্থ আদায়ে একটি কল ব্যাক নোটিশ জারি করে।

ওই নোটিশে প্রতিষ্ঠানটির কাছে বকেয়া ৩৮ কোটি ৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে ওই অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়।

নোটিশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ না করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইসলামী ব্যাংক বগুড়া বড়গোলা শাখার প্রধান তৌহিদ রেজার স্বাক্ষরিত ওই নোটিশ মাহমুদুর রহমান মান্না এবং তার দুই অংশীদারের ঠিকানায় পাঠানো হয়। ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, আফাকু কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডে মাহমুদুর রহমান মান্নার মালিকানা ৫০ শতাংশ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবিএম নাজমুল কাদির শাজাহান চৌধুরীর অংশ ২৫ শতাংশ এবং তার স্ত্রী ও পরিচালক ইসমত আরা লাইজুর অংশ ২৫ শতাংশ। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক বাজারে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটির কাছে খেলাপি বিনিয়োগ বাবদ মোট ৩৮ কোটি ৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে বলে ব্যাংক দাবি করেছে।

ইসলামী ব্যাংকের নোটিশ অনুযায়ী, ২০১০ সালে আফাকু কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডকে ২২ কোটি টাকা বিনিয়োগ অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তবে নিয়মিতভাবে মুনাফা, চার্জ এবং জরিমানা পরিশোধ না করায় বকেয়ার পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমান অঙ্কে পৌঁছেছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক হলেও ঋণ পরিশোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

ফলে চূড়ান্ত সতর্কতা হিসেবে কল ব্যাক নোটিশ জারি করা হয়। ইসলামী ব্যাংক বগুড়া বড়গোলা শাখার প্রধান তৌহিদ রেজা বলেন, ঋণখেলাপি হওয়ার পরও মাহমুদুর রহমান মান্না বকেয়া পরিশোধে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেননি।

চুক্তি অনুযায়ী দায় পরিশোধ না করায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আইনগত প্রক্রিয়ায় যেতে বাধ্য হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই রিট খারিজের মধ্য দিয়ে শুধু একটি আইনি বিষয়ই নিষ্পত্তি হয়নি, বরং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তাও বহন করছে। ঋণখেলাপি প্রার্থীদের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ও আদালতের কঠোর অবস্থান ভবিষ্যতে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রেও দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

একই সঙ্গে এটি রাজনীতিতে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার প্রশ্নকে নতুন করে সামনে এনেছে। নাগরিক ঐক্যসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে এই রায়ের প্রতিক্রিয়া মিশ্র হলেও দলটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আপিল বিভাগে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা তারা এখনো ছাড়েননি।

অন্যদিকে সরকারি ও আইন সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, আদালতের এই সিদ্ধান্ত আইনের শাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা জোরদার করতে ভূমিকা রাখবে।

সব মিলিয়ে, ঋণখেলাপি ইস্যুকে কেন্দ্র করে মাহমুদুর রহমান মান্নার রিট আবেদন খারিজ হওয়ার ঘটনাটি শুধু ব্যক্তিগত বা দলীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না থেকে জাতীয় রাজনীতিতে আর্থিক শৃঙ্খলা, নির্বাচনযোগ্যতা এবং আইনি জবাবদিহিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top