ইমতিয়াজ উদ্দিন, জবি প্রতিনিধি:
বিয়ে শুধু দুটি মানুষের মিলন নয়, এটি একটি সামাজিক বন্ধন যা দায়িত্ব, সমঝোতা ইত্যাদিকে নির্দেশ করে। সমাজের প্রাচীনতম এই প্রতিষ্ঠান ‘বিয়ে’ যুগে যুগে পরিবার গঠনের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু যখন এই দায়িত্ব শিক্ষার্থী অবস্থায় কাঁধে চেপে বসে, তখন তা জীবনের গতিপথকে কতটা প্রভাবিত করে? এটি কি সত্যিকারের ভালোবাসার বিজয়, নাকি অপরিণত সিদ্ধান্তের ভার?
শিক্ষার্থী জীবন হলো ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ার সময়। এই সময়ে মূল লক্ষ্য থাকে জ্ঞানার্জন, দক্ষতা অর্জন এবং ক্যারিয়ারের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। কিন্তু যখন এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে বিয়ের মতো একটি বড় দায়িত্ব যুক্ত হয়, তখন তা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপের সৃষ্টি করে। অপ্রতুল আর্থিক সংগতি, পড়াশোনার চাপ এবং মানসিক অপরিণতির কারণে অনেক দম্পতি সংসার জীবনের শুরুতেই হোঁচট খান। সম্পর্কের টানাপোড়েন, দ্বন্দ্ব এবং অস্থিরতা তাদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তোলে। বিশেষত পরিবার যখন শিক্ষার্থী জীবনের বিয়েকে সমর্থন করে না, শিক্ষার্থী দম্পতিকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করে না তখন শিক্ষার্থী জীবনের বিয়ে মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তবে সব ক্ষেত্রেই যে নেতিবাচক ফল আসে, তা নয়। কিছু দম্পতি পারস্পরিক সহযোগিতা, ধৈর্য এবং বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হন। তারা একে অপরের পড়াশোনায় উৎসাহ দেন, আর্থিক সীমাবদ্ধতাকে মেনে নেন এবং সমাজের সমালোচনা উপেক্ষা করে এগিয়ে যান। তাদের জন্য বিয়ে শুধু আবেগ নয়, একটি যৌথ লক্ষ্য অর্জনের পথ। কিন্তু এমন সাফল্যের গল্প সংখ্যায় খুবই কম। বিশেষত পরিবার যদি অর্থনৈতিকভাবে শিক্ষার্থী দম্পতির পাশে দাঁড়ায় তখন শিক্ষার্থী জীবনের বিয়ে মানসিক চাপ হ্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের সমাজে শিক্ষার্থী অবস্থায় বিয়েকে এখনও অনেক পরিবার সমর্থন করেন না। বিশেষ করে ছেলেদের ক্ষেত্রে এই চাপ আরও বেশি। পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশা থাকে যে তারা প্রথমে ক্যারিয়ারে স্থিতিশীল হোক, তারপর দায়িত্ব নিক। অন্যদিকে মেয়েদের ক্ষেত্রেও উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। ফলে শিক্ষার্থী অবস্থায় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া দুঃসাহসিক কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, বিয়ে শুধু আবেগের বিষয় নয়, এটি একটি টিমওয়ার্ক। দুজন মানুষকে একসঙ্গে চলার জন্য প্রয়োজন পরিপক্বতা, বোঝাপড়া এবং সমন্বয়ের দক্ষতা। শিক্ষার্থী জীবনে এই গুণগুলো অনেক সময়ই পূর্ণতা পায় না। ফলে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়, যা শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আবার যারা এই চাপ সামলাতে পারেন, তাদের জন্যও পথ মসৃণ হয় না। আগেই বলেছি, পরিবার ও সমাজের সমর্থন না পেলে তাদের সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে ওঠে।
শিক্ষার্থী দম্পতিদের জন্য পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি তারা একবার বিয়ে করে ফেলেন, তবে পরিবারের উচিত তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। আর্থিক ও মানসিক সহযোগিতা তাদের পথ চলাকে সহজ করতে পারে। অন্যদিকে অসহযোগিতা ও সমালোচনা তাদের ভুল পথে ঠেলে দিতে পারে। তাই পরিবারকে বুঝতে হবে যে এই দম্পতিরা তাদের সন্তান এবং তাদের ভবিষ্যৎই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষার্থী অবস্থায় বিয়ে করার আগে প্রত্যেকেরই কিছু বিষয় গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত। প্রথমত, আর্থিক সচ্ছলতা কি আছে? দ্বিতীয়ত, পড়াশোনা ও সংসার—দুটোকেই সামলানোর মানসিক প্রস্তুতি কি আছে? তৃতীয়ত, পরিবার ও সমাজের সমর্থন কি পাওয়া যাবে? যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ইতিবাচক হয়, তাহলে হয়তো এই সিদ্ধান্ত সফল হতে পারে। অন্যথায় তা জীবনের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
শিক্ষার্থী জীবনে বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিশেষত আমাদের সমাজে যে অবৈধ প্রেম ও অশ্লীলতা হানা দিয়েছে তা থেকে শিক্ষার্থী জীবনকে রক্ষা করতে বিয়ের কোনো বিকল্প বৈধ পথ নেই। কিন্তু সেই পথকে সহজ করতে আমাদের অভিভাবকদের ভূমিকা অপরিসীম।
বিয়ে একটি সুন্দর সম্পর্ক, কিন্তু তা তখনই সার্থক যখন দুজন মানুষ পরিপক্বতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে এগিয়ে যায়। শিক্ষার্থী জীবন হলো ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময়। এই সময়ে যদি বিয়ের মতো বড় দায়িত্ব নেওয়া হয়, তবে তা যেন ভবিষ্যৎকে অন্ধকার না করে। বরং দুজন মিলে যেন একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা যায়, সেদিকেই নজর দেওয়া উচিত। কারণ বিয়ে কোনো খেলার বিষয় নয়, এটি একটি জীবনব্যাপী দায়িত্ব।