জাকির হোসেন হাওলাদার, দুমকি ও পবিপ্রবি (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) একুয়াকালচার বিভাগের উদ্যোগে বাস্তবায়িত কোরাল মাছ চাষ বিষয়ক গবেষণাপ্রকল্পের সমাপনী সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (২৮ জুন ২০২৫) বিকাল ৩টায় কুয়াকাটার হোটেল মোহনা ইন্টারন্যাশনালে আয়োজিত এই সেমিনারে উপকূলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক ও প্রাকৃতিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ উৎপাদনের সম্ভাবনা ও সাফল্য তুলে ধরা হয়।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন প্রকল্পটির প্রধান গবেষক ও পবিপ্রবির একুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক। সঞ্চালনা করেন সহযোগী প্রধান গবেষক ও ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আরিফুর রহমান।
ভাইস-চ্যান্সেলর এর কথা:- গবেষণা ও সেমিনার সম্পর্কে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন,“গবেষণাভিত্তিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী সমস্যাভিত্তিক সমাধান উদ্ভাবন করা। পবিপ্রবির গবেষকরা এ প্রকল্পের মাধ্যমে সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। কোরাল মাছের মতো মূল্যবান সামুদ্রিক প্রজাতিকে স্থানীয় পর্যায়ে চাষোপযোগী করে তোলা একটি সময়োপযোগী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ। সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্য উদ্ভাবন এবং তার সাফল্য শুধু উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্যচাষীদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন নয়, বরং দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চয়তার দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
তিনি আরও বলেন,“বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগুলো যেন শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ না থেকে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত হয় এবং কৃষক, চাষি ও উপকূলীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নে কাজে লাগে—এটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা এ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সকল গবেষক, মৎস্য অধিদপ্তর এবং অংশগ্রহণকারী চাষিদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এবং ভবিষ্যতেও এ ধরনের যৌথ গবেষণার ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।”
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের পরিচালক মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন পবিপ্রবির মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মো. সাজেদুল হক, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম এবং উপ -প্রকল্প পরিচালক এস. এম. আজহারুল ইসলাম।
গবেষণার মূল বিষয় ও ফলাফল:- সেমিনারে প্রকল্পের ফলাফল উপস্থাপনকালে প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জানান, পুষ্টিসমৃদ্ধ কোরাল মাছ আমিষ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের উৎকৃষ্ট উৎস। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নয়নসহ নানা স্বাস্থ্য উপকারে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশে এখনও কোরাল মাছের হ্যাচারি না থাকায় থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা পোনা নার্সারি পুকুরে লালন করা হয়। মাৎস্যচাষী প্রকৃতির এই মাছকে দিনে ৪–৬ বার ৫০% আমিষসমৃদ্ধ শৈবালমিশ্রিত কৃত্রিম খাদ্য দেওয়া হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্যে ১০% শৈবাল যুক্ত করলে মাছের উৎপাদন সর্বাধিক হয়। প্রতি শতাংশে ২২টি পোনা মজুদ করে দেহ ওজনের ৩% হারে ১০% শৈবালযুক্ত খাদ্য দিনে ২ বার খাওয়ালে এক বছরে মাছের ওজন ২ থেকে ৩.৫ কেজি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
এই সাফল্য দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্যচাষীদের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রকল্পের আওতায় ২৫০ জন চাষীকে প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তা প্রদান করা হয়। গবেষণার অংশ হিসেবে পানির গুণমান, মাছের রক্ত ও রক্তরস বিশ্লেষণ, প্লাংকটন বৈচিত্র্য এবং ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি নিয়েও গবেষণা হয়েছে।
সুফলভোগীর অভিজ্ঞতা:- সুফলভোগী মৎস্যচাষী মো. আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি এই প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে ৩.৫ থেকে ৪ কেজি ওজনের কোরাল মাছ উৎপাদন করেছেন এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছেন।
অতিথিদের বক্তব্য:-প্রধান অতিথির বক্তব্যে মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী বলেন, “এই গবেষণার মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলে কোরাল মাছ চাষের একটি টেকসই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার ফলাফল মাঠপর্যায়ে প্রয়োগযোগ্য প্রযুক্তি হয়ে উঠলে তা জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।”
বিশেষ অতিথি প্রফেসর ড. মো. সাজেদুল হক বলেন, “গবেষকদের আন্তরিকতা ও একাগ্রতায় অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এ প্রকল্প সফল হয়েছে। এ ধরণের ফলাফলভিত্তিক গবেষণা বাংলাদেশের মৎস্য খাতকে আরও সমৃদ্ধ করবে।”
প্রকাশনা ও সমাপ্তি:- সেমিনারের শেষ পর্বে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলামের সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পরে উপস্থিত অতিথিদের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের পুকুরে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ চাষ’ বিষয়ক একটি লিফলেটের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন পবিপ্রবির বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা এবং বিভিন্ন এলাকার মৎস্যচাষীরা। এই গবেষণাপ্রকল্পের মধ্য দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই, বিজ্ঞানসম্মত ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক কোরাল মাছ চাষের একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো বলে মন্তব্য করেন অংশগ্রহণকারীরা। জাকির হোসেন হাওলাদার সাংবাদিক দুমকি পটুয়াখালী মোবাইল নম্বর ০১৭৩৯৪৮৮৫৭৪।