জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
নাইলের তীর ঘেঁষা সোনালি মরুভূমি যেন সময়ের গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। সেই শূন্যতার বুক চিরে আকাশ ছুঁতে চাওয়া কিছু বিশাল পাথরের স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে হাজার বছর ধরে। এগুলো শুধু স্থাপত্য নয়—এগুলো ইতিহাসের ছন্দ, সভ্যতার স্তবগান, আর মানব স্বপ্নের পাথরে লেখা মহাকাব্য। এই নামই পিরামিড।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ সালের প্রাচীন মিশর। ফারাও খুফুর এক স্বপ্নের সঙ্গে শুরু হয় এই বিস্ময়ের গল্প। প্রায় আড়াই মিলিয়নের বেশি চুনাপাথরের ব্লক, প্রতিটির ওজন দুই থেকে পনের টন, কোনো আধুনিক যন্ত্র ছাড়াই মরুভূমির বুকের ওপর স্থাপন করা হলো এমনভাবে, যেন প্রতিটি স্তর সময়কে ছুঁয়ে থাকা এক কবিতার পঙ্ক্তি। গিজার মহাপিরামিড তখন শুধু এক সমাধি নয়, মৃত্যুকে অতিক্রম করে অমরত্বের সন্ধান।
পিরামিডের ভেতরে প্রবেশ করলে এক অদ্ভুত নীরবতা চারপাশকে ঘিরে ধরে। সরু করিডোর, অন্ধকার গোপন চেম্বার আর দেয়ালে খোদাই করা হায়ারোগ্লিফিক লেখা যেন ইতিহাসের বুক থেকে উঠে আসা এক অমর ফিসফিসানি। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, মৃত্যু কোনো শেষ নয়, বরং নতুন এক জীবনের দরজা। সেই অমর যাত্রাকে সুরক্ষিত করতেই তারা গড়েছিল এই পাথরের মহাকাব্য।
গিজার মহাপিরামিডের আরেক বিস্ময় লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানের ভেতর। পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ অক্ষের সঙ্গে এর অবস্থান এতটাই নিখুঁত যে আধুনিক প্রযুক্তির সঠিকতাও এর সামনে বিস্মিত। গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, পিরামিডের অনুপাতের ভেতর লুকিয়ে আছে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের সূক্ষ্ম রহস্য। অনেকেই একে প্রাচীন যুগের এক গোপন মানমন্দির বলে আখ্যা দেন। আশ্চর্যের বিষয়, গিজার মহাপিরামিডের অবস্থান পৃথিবীর ভূ-ভাগের প্রায় গাণিতিক কেন্দ্রের কাছাকাছি।
তবে পিরামিড কেবল পাথরের স্থাপত্য নয়; এটি মানুষের ঘাম, স্বপ্ন আর বিশ্বাসের সংমিশ্রণ। ধারণা করা হয়, প্রায় এক লক্ষের বেশি দক্ষ শ্রমিক দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই মহাকীর্তি নির্মাণ করেছিলেন। ইতিহাসবিদদের মতে, এটি কেবল ফারাওদের ক্ষমতার প্রতীক ছিল না, বরং প্রাচীন মিশরীয়দের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর ঐক্যের অনন্য দলিল।
পিরামিডকে ঘিরে অসংখ্য রহস্য ও কিংবদন্তি। কেউ বলেন, এর নির্মাণে ভিনগ্রহের সাহায্য ছিল; কেউ বলেন, এর গভীরে লুকিয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া কোনো প্রাচীন জ্ঞানের ভাণ্ডার। কেউ আবার বিশ্বাস করেন, এর প্রতিটি পাথরের মাঝে লুকিয়ে আছে মানব সভ্যতার সূচনার গোপন কাহিনি। কিন্তু সব রহস্যের ওপরে যে সত্যটি অটল—পিরামিড মানব স্বপ্নের অমর প্রতীক।
আজও যখন সূর্যাস্তের লাল আলো গিজার বালুর ওপর ছড়িয়ে পড়ে, তখন মনে হয়, এই পাথরের স্তূপ কেবল ইতিহাস নয়—এটি এক জীবন্ত মহাকাব্য। প্রতিটি পাথর যেন ফিসফিস করে বলে, “আমরা কেবল মরুভূমির বুকের স্মারক নই, আমরা মানুষের অদম্য সাধনার অমর দলিল।”
পিরামিডের সামনে দাঁড়ালে সময় থেমে যায়। ইতিহাস, বিশ্বাস আর স্বপ্নের মিশেলে তৈরি এই বিস্ময় আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সভ্যতা কেবল প্রযুক্তির গল্প নয়; এটি মানুষের হৃদয়ের গল্প। আর সেই হৃদয়েরই অমর প্রতিচ্ছবি গিজার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিড, যা আজও বলে যায়—স্বপ্ন যতদিন থাকবে, ততদিন মানুষ অনন্তকে ছুঁতে চাইবে।
লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর