নিজস্ব প্রতিনিধি:
ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গত এক বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কার এনেছে। রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে ওঠা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং খেলাপি ঋণের স্বচ্ছ হিসাব প্রকাশ করে সরকার এই খাতে জনআস্থা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট সরকার ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের জন্য একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল আর্থিক খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করে টেকসই সমাধান বের করা।
কোভিড-পরবর্তী সময়ে আমদানি ব্যয় ও অর্থপাচারের কারণে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে। ২০২৪ সালের আগস্টে আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ নেমে আসে ২০.৪৭ বিলিয়ন ডলারে। তবে সরকারের নানা পদক্ষেপের ফলে এক বছরের মধ্যে রিজার্ভ বেড়ে ২৫.০৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। সাধারণ হিসাবে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ৩০.০৮ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “রিজার্ভ থেকে বড় কোনো পরিশোধ করতে হয়নি, বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন অতিরিক্ত ডলার কিনে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ করছে।” গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, “২০২৪ সালের জুলাইয়ে রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে গিয়েছিল, সেখানে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে তা ৩০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে—এটা বিশাল অর্জন।”
ড. ইউনূস সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রবাসীদের আস্থা ফিরে আসে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ স্থবির হয়ে পড়েছিল, কিন্তু নতুন সরকারের উদার নীতি ও প্রণোদনার ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৩০.৩৩ বিলিয়ন ডলারে, যা দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ। এই প্রবাহ আগের বছরের তুলনায় ২৬.৮ শতাংশ বেশি।
মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে এসেছে। গত বছর আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৪৯ শতাংশ, যা ২০২৫ সালের জুনে নেমে আসে ৮.৪৮ শতাংশে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭.৩৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতি, নীতি সুদহার বৃদ্ধি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে শুল্ক হ্রাস এই সাফল্যের পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলেও সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপে বর্তমানে ব্যাংকে প্রতি ডলারের দর ১২১.৩৫ থেকে ১২১.৯০ টাকার মধ্যে স্থিতিশীল রয়েছে।
খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা হয়েছে। আগের সরকারের আমলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র গোপন রাখা হতো। ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, যা এক বছরে বেড়ে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ভুয়া জামানত, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতাই এই সংকটের মূল কারণ।
সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন করে গঠন করেছে। সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, রিজার্ভ রক্ষা এবং আমদানি-বাণিজ্যে গতিশীলতা আনার পদক্ষেপ ইতিবাচক ফল দিচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা রাজনীতি নয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতেই কাজ করছি। অন্তর্বর্তী সরকারের এই অর্জন ধরে রাখা গেলে বাংলাদেশ একটি আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাবে।”