আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি সাতজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে হেলিকপ্টারে পালিয়েছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনি ভারত অথবা দুবাইয়ে আশ্রয় নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রীকে রাস্তায় মারধর করা হয়েছে, অলি’র বাড়ি ও মন্ত্রীদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে, এমনকি মাওবাদী নেতা প্রচন্ডের বাড়িতেও বিক্ষোভকারীরা হামলা চালিয়েছে। নেপালি কংগ্রেসের দপ্তরেও আগুন লাগানো হয়েছে। পুরো রাজধানী এখন ছাত্র-যুবকদের দখলে, যারা সামাজিক মাধ্যমের অধিকার ফিরিয়ে পেলেও রাস্তা ছাড়তে নারাজ। তারা দুর্নীতি বন্ধ, বেকারত্ব নিরসন, গুলি চালানোর বিচার ও নতুন ব্যবস্থার দাবি তুলছেন। সেনাবাহিনী এখনো হস্তক্ষেপ করেনি, শুধু নীরবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
এই বিক্ষোভ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। শ্রীলংকায় ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট ও এক পারিবারিক শাসনের পতনের পর, বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়ে সরকার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এবার নেপালে সামাজিক মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ বেকারত্ব ও দুর্নীতিবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। শ্রীলংকায় ভুল অর্থনৈতিক নীতি, হঠাৎ কর কমানো, বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা, কৃষিতে বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত, কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত মিলিয়ে দেশ অচল হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন-পীড়নের মুখে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা সরকার পতনের পথ তৈরি করে।
নেপালের বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল সামাজিক মাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে। সরকার ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামসহ ২৬টি প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেয়, যা ব্যবসা, পর্যটন, প্রবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং লাখো মানুষের আয়ের পথ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু আন্দোলন দ্রুত বিস্তৃত হয়ে দুর্নীতি ও বেকারত্ববিরোধী জনরোষে পরিণত হয়। বিক্ষোভকারীরা বলছে, নেতাদের সন্তানরা বিলাসিতায় বড় হচ্ছে অথচ সাধারণ তরুণদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তারা বলছেন, এই আন্দোলন শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, এটি জেন-জির বিপ্লব, যা রাষ্ট্রের কাছে নতুন সমাজ তৈরির দাবি তুলছে।
প্রশ্ন উঠছে, দক্ষিণ এশিয়ার এই অস্থিরতার ঢেউ কি এবার ভারতেও আছড়ে পড়বে? ভারতের অর্থনীতি শ্রীলংকা বা নেপালের মতো দুর্বল নয়, শেয়ারবাজারে নতুন রেকর্ড, বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধিই তার প্রমাণ। তবে একই সঙ্গে বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি ভারতের সাধারণ মানুষকে চাপে ফেলছে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। অতীতে বিতর্কিত কৃষি আইন ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছিল, যেখানে সরকারের নতি স্বীকার করতে হয়েছিল।
তবু ভারত এখনো তুলনামূলক স্থিতিশীল। একদিকে লাগাতার নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা মানুষের মধ্যে সংসদীয় ব্যবস্থার ওপর আস্থা জাগিয়েছে, যা বাংলাদেশ, নেপাল বা শ্রীলংকার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত। তবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের ভোটাভ্যাস ও বিশ্বাসে ফাটল ধরছে, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাম্প্রতিক বিক্ষোভগুলো প্রমাণ করেছে, দুর্নীতি, বৈষম্য, বেকারত্ব ও রাজনৈতিক অদক্ষতার মতো দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। আর সেই আগুন এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয় না। ভারতও এই ঝুঁকির বাইরে নয়।
সৌজন্যে: বাংলাবাজার ইউটিউব চ্যানেল