১০ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৮ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

যে দেশে জুতা থাকে শো রুমে আর বই থাকে ফুটপাতে সেই দেশে বই নিয়ে, বই মেলা নিয়ে অবহেলা তো হবেই।”

ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ:

​বই কেবল কাগজের স্তূপ নয়; এটি মানব ইতিহাসের সঞ্চিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং স্বপ্নের ধারক। যখন একটি সমাজে বইকে ফুটপাতে বা অবহেলার জায়গায় রাখা হয়, তখন বুঝতে হবে সেই সমাজ জ্ঞানের মূল‍্য দিতে শেখেনি, বরং তারা কেবল ক্ষণস্থায়ী বৈষয়িক চাকচিক্যকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।

​বিখ্যাত আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক মার্ক টোয়েন (Mark Twain) বলেছিলেন: ​“A person who won’t read has no advantage over one who can’t read.”
এই উক্তিটি স্পষ্ট করে যে বই পাঠের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যারা তা করে না, তারা কার্যত নিরক্ষর মানুষের মতোই। বইকে অবজ্ঞা করা মানে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা।

অন্যদিকে, কল্পবিজ্ঞানের কিংবদন্তী লেখক কার্ল সেগান (Carl Sagan) বইকে এক অনন্য মর্যাদা দিয়েছিলেন: ​“Books break the shackles of time,proof that humans can work magic.” (বই সময়ের শিকল ভাঙে,এটি প্রমাণ করে যে মানুষ জাদু করতে পারে।)

একটি উন্নত সমাজে বইকে শো-রুমের মতোই সম্মানের আসনে রাখা হয়, কারণ তারা জানে যে সাহিত্য ও জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সেতু বন্ধন করে। উন্নত বিশ্ব বইকে পণ্য হিসেবে নয়, বরং “পোর্টেবল ম্যাজিক” (portable magic) হিসেবে দেখে, যেমনটি বলেছিলেন লেখক স্টিফেন কিং (Stephen King)।

​দেশি লেখকের দৃষ্টিতে অবহেলা
​আমাদের দেশি লেখকরাও সমাজের এই দৈন্যদশা নিয়ে বহুবার সরব হয়েছেন। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার লেখায় কিংবা বক্তব্যে সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক পতন নিয়ে আক্ষেপ করেছেন। তিনি যেমন তার সময়ের লেখকদের সংগ্রাম নিয়ে লিখেছেন, তেমনি বই পাঠকের স্বল্পতাও ছিল তার উদ্বেগের কারণ। ​তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, একটি সমাজের ‘শিক্ষিত’ মানুষের বইয়ের প্রতি উদাসীনতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু আগেই বলেছিলেনঃ ​“আমাদের দেশে যে বিদ্যার চর্চা হয়, তাহাতে আমরা পাণ্ডিত্য লাভ করি, কিন্তু মননশক্তি লাভ করি না।”
তাঁর এই উক্তিটি আজকের প্রেক্ষাপটে আরও সত্য। আমাদের সমাজে শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন নয়, কেবল ডিগ্রি ও অর্থ উপার্জনের পথ তৈরি করা। আর তাই, যে বই মননকে শাণিত করে, প্রশ্ন করতে শেখায়, তাকে অবহেলার পাত্রে ঠেলে দেওয়া হয়।

​বইমেলাঃ বাণিজ্যের কেন্দ্র না মননের উৎসব?

​বইমেলা একটি জাতির সাংস্কৃতিক মানদণ্ড। উন্নত দেশগুলোতে বইমেলা জ্ঞানের আদান-প্রদান, সাহিত্যিক বিতর্ক ও নতুন ধারণার উন্মোচনের মঞ্চ। কিন্তু যখন বই থাকে ফুটপাতে আর জুতা থাকে শো-রুমে, তখন বইমেলাও তার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে একটি বাণিজ্যিক উৎসব বা নিছক বিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত হয়।

​পশ্চিমের বইমেলার প্রেক্ষাপটঃ

​জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা বা ইংল্যান্ডের লন্ডন বইমেলা বিশ্বজুড়ে পরিচিত কেবল বই বেচার জন্য নয়, বরং স্বত্ব কেনাবেচা, লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন, সাহিত্য আলোচনা এবং মননশীলতার চর্চার কেন্দ্র হিসেবে। সেখানে বইয়ের প্রকাশনা ও বিপণনকে একটি শিল্প এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই মেলাগুলোতে বইয়ের অবস্থান হয় অত্যন্ত সুরক্ষিত ও সুসজ্জিত পরিবেশে, যা এর অন্তর্নিহিত মূল্যকেই প্রতিফলিত করে।

​আমাদের সমাজের বাস্তবতাঃ

​আমাদের দেশে বইমেলার বাইরের চিত্রটি কী? পুরনো বইয়ের বাজারগুলো ফুটপাতে, বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা ধুলোয় ঢাকা। এই দৃশ্য আসলে সমাজের মানসিকতারই প্রতিচ্ছবি। এই মানসিকতা বইয়ের জ্ঞানকে তুচ্ছ করে এবং ভোগবাদী সংস্কৃতিকে (consumerist culture) প্রাধান্য দেয়, যেখানে জুতা বা প্রসাধনী শো-রুমের দামি কাঁচের আড়ালে সর্বোচ্চ মনোযোগ লাভ করে। ​মনস্তত্ত্ববিদ ও সাহিত্য সমালোচক ফ্রাঞ্জ কাফকা (Franz Kafka) বইয়ের ভূমিকা বোঝাতে গিয়ে বলেন: ​“A book should serve as the ax for the frozen sea within us.”
​বই যেখানে মানুষের ভেতরের স্থবিরতাকে ভাঙার হাতিয়ার, সেখানে তাকে ফুটপাতে ফেলে রাখা মানে আমাদের সমাজের মননশীলতার স্থবিরতাকেই স্বীকৃতি দেওয়া। যখন সমাজে অবশ্য প্রয়োজনীয় বস্তু (necessity) এবং বিলাসিতা (luxury)-এর সংজ্ঞা ভুল পথে চালিত হয়,যখন জুতা হয়ে ওঠে ‘বিলাসিতা’ আর বই হয়ে ওঠে ‘অবশ্য প্রয়োজনীয়তা’র বাইরে,তখন এর পরিণতি হয় বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যাত্ব।

অবহেলার চরম মূল্যঃ

​যে সমাজ বই ও জ্ঞানকে মর্যাদা দেয় না, সেই সমাজ প্রগতি, মননশীলতা ও সৃজনশীলতা থেকে পিছিয়ে থাকে। জুতা বা পোশাক একটি মানুষকে সাময়িক আত্মবিশ্বাস বা আরাম দিতে পারে, কিন্তু বই একটি জাতিকে যুগ যুগ ধরে নেতৃত্ব দিতে পারে। ফুটপাতে বইয়ের অবস্থান এবং শো-রুমে জুতার জাঁকজমক—এই বৈপরীত্যই বলে দেয় আমাদের সমাজ কোন দিকে ঝুঁকছে। ​যদি আমরা একটি উন্নত জাতি গঠন করতে চাই, তবে বইকে অবশ্যই তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। বইয়ের ঠাঁই দিতে হবে মননে, পাঠাগারে এবং আধুনিক, সুসজ্জিত বিপণিতে। যতক্ষণ না এই পরিবর্তন আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বইমেলা কেবল ক্ষণিকের লোক-দেখানো উৎসব হয়েই থাকবে, আর এই অবহেলা আমাদের জাতিগতভাবে এক চরম মূল্য দিতে বাধ্য করবে।

লেখক,কবি ও গল্পকার

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top