৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৫ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বাংলাদেশ–সৌদি আরবের মধ্যে সাধারণ কর্মী নিয়োগে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর

নিজস্ব প্রতিনিধি:

বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সাধারণ কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত এক ঐতিহাসিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তিকে দুই দেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণ এবং অভিবাসন ব্যবস্থার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সোমবার (৬ অক্টোবর) রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং সৌদি আরব সরকারের পক্ষে মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ বিন সোলাইমান আল-রাজী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরে এটাই প্রথমবারের মতো সাধারণ কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক চুক্তি। এর আগে ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে শ্রমিক প্রেরণ শুরু হয়, যা এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ লাখে পৌঁছেছে। এই কর্মীরা বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখে আসছেন।

এর আগে, ২০১৫ সালে গৃহকর্মী নিয়োগ এবং ২০২২ সালে দক্ষতা যাচাই ও স্বীকৃতি সংক্রান্ত দুটি বিশেষ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তবে সাধারণ কর্মী নিয়োগে এটি প্রথম আনুষ্ঠানিক চুক্তি, যা প্রবাসী কর্মীদের অধিকার, সুরক্ষা এবং স্বচ্ছ নিয়োগ ব্যবস্থার নিশ্চয়তার দিক থেকে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে দক্ষ, আধা-দক্ষ ও সাধারণ শ্রমিক প্রেরণের সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে প্রশিক্ষণ, দক্ষতা যাচাই, নিরাপদ অভিবাসন এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। পাশাপাশি নিয়োগকর্তা ও কর্মীর মধ্যে চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক, আকামা নবায়ন, এবং এক্সিট ভিসা প্রদানের প্রক্রিয়া আরও নির্ভুলভাবে বাস্তবায়িত হবে।

চুক্তি স্বাক্ষরের আগে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ড. আসিফ নজরুল সৌদি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান, যেন কর্মীদের অধিকার সংরক্ষণ, আকামা নবায়ন এবং দেশে ফেরত যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের দ্রুত এক্সিট ভিসা প্রদানের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হয়। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত কর্মীদের আমরা প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা সার্টিফিকেশন নিশ্চিত করব, যাতে সৌদি আরব আরও দক্ষ ও গুণগতমানসম্পন্ন শ্রমশক্তি পায়।”

জবাবে সৌদি মন্ত্রী আহমেদ বিন সোলাইমান আল-রাজী বলেন, “বাংলাদেশ আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার অংশীদার। এই চুক্তি শুধুমাত্র নিয়োগ নয়, মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এক নতুন সূচনা।” তিনি উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে কর্মী কল্যাণ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং আইনি সুরক্ষার বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন।

এছাড়াও বৈঠকে সৌদি বিনিয়োগে বাংলাদেশে প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন, কর্মী নিয়োগে ডিজিটাল যাচাইকরণ ব্যবস্থা চালু, নারী কর্মীদের সুরক্ষা এবং অবৈধ দালাল চক্র দমনে যৌথ মনিটরিং সিস্টেম গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা হয়।

চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. দেলওয়ার হোসেন, মিশন উপপ্রধান এস. এম. নাজমুল হাসান, শ্রম কাউন্সেলর মুহাম্মাদ রেজায়ে রাব্বী এবং দুই দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে আগামী দুই বছরের মধ্যে সৌদি আরবে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা অন্তত ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখ বাংলাদেশি কর্মী সেখানে কর্মরত আছেন, যারা বছরে প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠান।

চুক্তির ফলে বাংলাদেশি কর্মীরা দক্ষতা অনুযায়ী উন্নত বেতন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা পাবেন। এছাড়া একটি যৌথ অনলাইন ডেটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হবে, যেখানে নিয়োগ ও কর্মচুক্তির তথ্য সংরক্ষিত থাকবে।

বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, এই ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “দক্ষ কর্মী রপ্তানি শুধু রেমিট্যান্স বাড়াবে না, এটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করবে।”

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top