নিজস্ব প্রতিনিধি:
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংঘটিত গুমের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। বুধবার (৮ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু হয়। তদন্তে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই ও পুলিশের সাবেক এবং বর্তমান কর্মকর্তারা। মোট ২৮ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হয়েছে, যাদের মধ্যে ১১ জন এখনও কর্মরত আছেন।
ডিজিএফআই, র্যাব ও সিটিআইবিতে কর্মরত তিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল, পাঁচ মেজর জেনারেল, ছয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, তিন কর্নেল এবং পাঁচ লেফটেন্যান্ট কর্নেলসহ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা অভিযুক্ত তালিকায় রয়েছেন। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদও এ মামলার আসামি। আদালত আসামিদের গ্রেপ্তার করে আগামী ২২ অক্টোবর শুনানির জন্য হাজির করার নির্দেশ দিয়েছে।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্যানেল এই আদেশ দেন। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি।
অভিযোগে বলা হয়েছে, জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি) ও র্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেল (টিএফআই) পরিচালিত “আয়নাঘর” ও অন্যান্য গোপন বন্দিশালায় মোট ৩৪ জনকে গুম, আটক ও নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এ দুটি মামলায় পৃথকভাবে ১৩ জন ও ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।
জেআইসি মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনা, মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) সাইফুল আবেদীন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) সাইফুল আলম, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হকসহ সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে টিএফআই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনা, তার উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশিদ হোসেন, ব্যারিস্টার হারুন-অর-রশিদসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তা।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তাকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হুসাইন তামিম। শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা, যেমন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী, হুম্মাম কাদের চৌধুরী, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম আরমান, মাইকেল চাকমা প্রমুখ।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আসামিরা গুম, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন ও হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি জড়িত ছিলেন। গত ১৫ বছরে র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে শত শত বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীকে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। এই মামলায় প্রমাণিত ঘটনাগুলোর ভিত্তিতেই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আটক ব্যক্তিদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হতো—হাত কেটে ফেলা, নখ উপড়ে ফেলা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করা ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে জবানবন্দি আদায় করা হতো। গোপন কক্ষগুলোকে বলা হতো “আয়নাঘর” বা “আর্ট গ্যালারি”, আর বন্দিদের ডাকা হতো “সাবজেক্ট” নামে।
বিনা অপরাধে আট বছর গুম থাকা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, “আমাকে কোনো কারণ ছাড়াই ডিজিএফআই আট বছর বন্দি করে রেখেছিল। আমি ন্যায়বিচার চাই। অপরাধী যেই হোক, তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।”
হুম্মাম কাদের চৌধুরী বলেন, “আমরা গুমের শিকার হয়েছি, কিন্তু আসল কষ্ট পেয়েছে আমাদের পরিবার। আমি বিশ্বাস করি, এই বিচার একদিন ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।”
মাইকেল চাকমা বলেন, “সাড়ে পাঁচ বছর আমাকে গুম করে রাখা হয়েছিল। আমি বিশ্বাস করি, এবার ন্যায়বিচার হবে এবং এ ধরনের জঘন্য কাজ আর কেউ করতে পারবে না।”
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “গুমের দায় কোনো বাহিনীর নয়; এটি ব্যক্তিগত অপরাধ। জনগণের বেতনে কাজ করা কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে এসব অপরাধ করেছেন।”
তিনি আরও জানান, আওয়ামী লীগ আমলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার গুমের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গুম কমিশনে এক হাজার ৮৩৭টি অভিযোগ জমা হয়েছে এবং এখনও ৩৪৫ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
এই মামলার মাধ্যমে বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের গুমের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিচারিক পদক্ষেপ শুরু হলো বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।