মোহাইমিনুল হাসান, ক্যাম্পাস প্রতিনিধি:
দীর্ঘ ৩৩ বছর ১১ মাস ১০ দিনের বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা জীবনের সফল সমাপ্তি টেনে গৌরবময় অবসরে গেলেন সরকারি শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা-এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর সাইফুল আলম নোমানী। আজ, ২০২৫ সালের ২৭শে অক্টোবর, তাঁর কর্মজীবনের এই দীর্ঘ ও প্রেরণাদায়ী অধ্যায়টি শেষ হলো।
প্রফেসর নোমানী তাঁর নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকতার মাধ্যমে হাজারো শিক্ষার্থীর জীবনে আলোর দিশা হয়ে উঠেছেন। তাঁর জীবনের এই দীর্ঘ পথচলা কেবল একটি পেশাগত দায়িত্ব পালন নয়, বরং এটি ছিল ভালোবাসা, আত্মতৃপ্তি ও জ্ঞান বিতরণের এক অবিরাম যাত্রা।
এক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের পদযাত্রা
১৯৯৩ সালের ১৫ই নভেম্বর, জামালপুর জেলার জাহেদা সফির সরকারি মহিলা কলেজে শিক্ষকতা জীবনের শুভ সূচনা করেন প্রফেসর সাইফুল আলম নোমানী। পরবর্তীতে মায়ের অসুস্থতার কারণে নিজ জেলা নেত্রকোনায় ও পরবর্তীতে ময়মনসিংহের মুমিনুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে যোগদান করেন এবং দীর্ঘ আট বছর নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি শেরপুর সরকারি কলেজ, বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ, সাভারের বিপিএটিসি (বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন গবেষণা কেন্দ্র), মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (D.G.) এবং নেত্রকোনা সরকারি কলেজসহ মোট সাতটি কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করেন।
২০২০ সালের ১৯শে জানুয়ারি, তিনি তাঁর অষ্টম ও শেষ কর্মস্থল হিসেবে সরকারি শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে যোগদান করেন। এই কলেজেই তাঁর শিক্ষকতা জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ ও স্মরণীয় সময় কেটেছে। ছোট অবকাঠামো সত্ত্বেও এখানকার শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের মধ্যে থাকা আন্তরিকতা, পারিবারিক বন্ধন ও সহমর্মিতা তাঁকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে।
সর্বোচ্চ প্রাপ্তি শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে স্যার বলেন, “আমার শিক্ষকতা জীবনের প্রতিটি দিনই ছিল স্মরণীয়। নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার কথা আলাদা করে বলা কঠিন, কারণ প্রতিটি ক্লাস, প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে ছিল আনন্দের।”একজন শিক্ষক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি তাঁর শিক্ষার্থীরা। তিনি বলেন, “যখন দেখি তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছে, সমাজে অবদান রাখছে, তখন আমার মনে হয়—আমার শ্রম সফল হয়েছে। হঠাৎ কোথাও দেখা হলে তারা যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করে, সেটাই আমার জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।”
সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের চোখে নোমানী স্যার:প্রফেসর নোমানীর সহকর্মীরা তাঁর ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষকতার প্রশংসা করেছেন অকুণ্ঠ চিত্তে।
অধ্যাপক দোলালী শারমিন বলেন, “নোমানী স্যার সত্যিই অসাধারণ। তিনি কখনো রাগেন না, ধৈর্য্য হারান না, বিরক্ত হন না। বিভাগীয় প্রধান হয়েও আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করেছেন। স্যারকে নিয়ে বলার মতো নেতিবাচক কিছু নেই—তিনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষ।”
আরেক সহকর্মী অধ্যাপক ফজলুল হক মন্তব্য করেন, “নোমানী স্যার একজন অসাধারণ মানুষ। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি আমাদের অনেকের আদর্শ ও প্রেরণার উৎস।”
স্যারের এই বিদায় শিক্ষার্থীদের হৃদয়েও গভীর রেখাপাত করেছে। ১৮-১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ইয়াসিন মোল্লা বলেন, “স্যার ছিলেন আমাদের বিভাগের প্রাণ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা কখনোই স্যারকে ভুলতে পারবে না। স্যার শুধু আমাদের শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন শিক্ষা-পরবর্তী জীবনের পথপ্রদর্শক। ব্যক্তি জীবনে স্যারকে অনেক মিস করব।”
২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী সিনজিদা রহমান কাকলী তাঁকে কেবল শিক্ষক নয়, বরং একজন অভিভাবক ও প্রিয় বন্ধু হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “স্যারের নেতৃত্বে আমরা কেবল পাঠ্যজ্ঞানই নয়, মানবিকতা, দায়িত্ববোধ ও একে অপরের পাশে থাকার শিক্ষা নিয়েছি।”
অবসর জীবনের নতুন দিগন্ত
অবসর-পরবর্তী জীবনে প্রফেসর সাইফুল আলম নোমানী সমাজের জন্য কাজ করতে চান। তাঁর ভাষায়— “আমি মানুষের উপকারে আসতে চাই, সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে চাই। পাশাপাশি একজন মুসলমান হিসেবে ধর্মীয় অনুশীলন ও ইবাদতে আরও মনোযোগী হতে চাই।”
শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর বার্তা, “শিক্ষার্থীরাই একটি জাতির প্রকৃত সম্পদ। তোমরা সঠিকভাবে পড়াশোনা করো, তোমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাও এবং দেশ ও জাতির উন্নয়নে অবদান রাখো। তোমাদের সাফল্যই একজন শিক্ষকের সর্বোচ্চ পুরস্কার।”
প্রফেসর সাইফুল আলম নোমানীর পরবর্তী জীবনের জন্য রইল আন্তরিক শুভকামনা। আশা করি অবসরকালের প্রতিটি দিন হবে শান্তি, আনন্দ ও সুস্বাস্থ্যে পরিপূর্ণ। তাঁর অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রেরণা যোগাবে।
উল্লেখ্য: নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার সি.কে.পি. পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি সম্পন্ন করার পর তিনি সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ, জামালপুর ও নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো— মাস্টার্স পরীক্ষার মাত্র একদিন আগেই তাঁর চাকরি হয় বাংলাদেশ সচিবালয়ের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। যদিও সেই দাপ্তরিক জীবনের বাঁধাধরা রুটিন তাঁর মনে অনুপ্রেরণা জাগাতে পারেনি; শিক্ষকতাই ছিল তাঁর সত্যিকারের আত্মতৃপ্তির স্থান।