নিজস্ব প্রতিনিধি:
২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে রাতের অন্ধকারে ব্যালট বাক্স ভরার অভিযোগের পেছনে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারীর সরাসরি ভূমিকা ছিল বলে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তার দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে উঠে এসেছে, নির্বাচনের আগের রাতে ৫০ শতাংশ ভোট ব্যালট বাক্সে ভরে রাখার নির্দেশ পুলিশ বাহিনীকে দিয়েছিলেন জাবেদ পাটোয়ারী। এছাড়া এই পদ্ধতিতে ভোট করার জন্য তিনিই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ২৪ মার্চ ঢাকার একটি আদালতে এই জবানবন্দি দেন কারাবন্দি আবদুল্লাহ আল-মামুন। সম্প্রতি জবানবন্দির খণ্ডিত অংশ প্রকাশিত হলে বিষয়টি আলোচনায় আসে। এর আগে জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থান দমনে পুলিশের নিষ্ঠুর ভূমিকা, গুলি চালানোর নির্দেশদাতাসহ বিভিন্ন সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল।
জবানবন্দিতে আবদুল্লাহ আল-মামুন জানান, ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় তিনি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ছিলেন। তখন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যালট (নৌকা মার্কায় সিল দিয়ে) রাতে বাক্সে ভরে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এই পরামর্শ সমর্থন করলে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসন ও পুলিশ তা বাস্তবায়ন করে। এ কাজে জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও), সহকারী কমিশনার (ভূমি), পুলিশ সুপার (এসপি) এবং থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি)রা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, পরবর্তীতে পুলিশের ব্রেভারি পদক (বিপিএম ও পিপিএম) বিতরণের ক্ষেত্রে নির্বাচনী দায়িত্বে সক্রিয় পুলিশ সদস্যদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এতে পেশাদারিত্বের চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য বেশি গুরুত্ব পায়।
জবানবন্দিতে পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথাও উল্লেখ করেন মামুন। তার মতে, ২০১৮ সালের পর পুলিশে রাজনৈতিক প্রভাব আরও বেড়ে যায়। কিছু পুলিশ অফিসার প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় রাতে নিয়মিত বৈঠক হতো, যেখানে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি নুরুল ইসলাম, এডিশনাল ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকার, এডিশনাল এসপি কাফি, ওসি মাজাহার, ফরমান ও অপূর্ব হাসানসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত থাকতেন। এরা প্রায়ই আইজিপির নির্দেশ উপেক্ষা করতেন এবং নিজেদেরকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান মনে করতেন।
মামুন তার জবানবন্দিতে গোপালগঞ্জ জেলার পুলিশ অফিসারদের বিশেষ প্রভাবের কথাও উল্লেখ করেন। তার মতে, পুলিশ বাহিনীতে গোপালগঞ্জ জেলার অফিসারদের আধিপত্য ছিল এবং তারা প্রায়ই চেইন অব কমান্ড মানতেন না। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তাদের নিয়োগ দেওয়া হতো।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সম্পর্কে মামুন বলেন, র্যাবের মাধ্যমে গুম, ক্রসফায়ার বা বিশেষ অপারেশনের নির্দেশনা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আসত। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকিও কিছু নির্দেশনা দিতেন। যদিও র্যাব আইজিপির অধীন, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশে কাজ করত।
তিনি আরও জানান, র্যাবের টিএফআই (টাস্ক ফোর্স ফর ইন্টারোগেশন) সেলে কতজন আটক রয়েছে, তা তাকে জানানো হতো না। উত্তরার র্যাব-১ কম্পাউন্ডে এই সেল অবস্থিত ছিল। এছাড়া র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটের নিজস্ব গোপন সেল ছিল, যেখানে রাজনৈতিক বিরোধীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটক রাখা হতো।
উল্লেখ্য, সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীকে তার সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। তিনি দুই দফায় এই দায়িত্ব পালন করেন এবং ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর বিদেশে পলাতক অবস্থায় রয়েছেন।
অন্যদিকে, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। এই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তিনি নিজেও আসামি।