১৯শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৭শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

পাঁচ দিনে তিন অগ্নিকাণ্ড: দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত নাশকতা—উঠছে নানা প্রশ্ন

নিজস্ব প্রতিনিধি:
গত কয়েক দিনে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে দেশে। কেপিআইভুক্ত ও জনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, যা জনমনে গভীর উদ্বেগ ও সন্দেহ তৈরি করেছে। সর্বশেষ শনিবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুন লাগে। এর আগে মিরপুরের রূপনগর ও চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি কারখানায় আগুনের ঘটনা ঘটে।

এমন ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত নাশকতা—এই প্রশ্ন এখন দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞদের মাঝেও ঘুরপাক খাচ্ছে। অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে নাশকতামূলক আগুন শনাক্ত করার মতো সক্ষমতা নেই। ফলে বড়-ছোট সব আগুনকেই দুর্ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয়, যা একটি বড় দুর্বলতা। তারা বলছেন, এসব ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত কারণ উদঘাটন না করলে তা দেশের ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জানিয়েছে, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডসহ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোয় নাশকতার কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানায়।

অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফেসবুকে এক পোস্টে এসব আগুনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বারবার অগ্নিকাণ্ড দেশের জননিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এক বিবৃতিতে বলেন, জনগণ এসব ঘটনাকে পূর্বপরিকল্পিত বলে বিশ্বাস করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হলেও সাম্প্রতিক ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অস্থির পরিবেশের মধ্যে কেউ কি পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটাচ্ছে—এ প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজা দরকার।

প্রসঙ্গত, ১৪ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় একটি পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জন নিহত হন। এরপর ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম ইপিজেডে ৯ তলা কারখানার ভবনে আগুন লাগে। মাত্র দুদিন পর শনিবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আবারও আগুন লেগে শত শত কোটি টাকার মালামাল পুড়ে যায়। পাঁচ দিনের মধ্যে এ তিনটি বড় দুর্ঘটনা জনমনে সন্দেহ বাড়িয়েছে—এগুলো কি সত্যিই দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত নাশকতা?

অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাকসুদ হেলালী বলেন, “নাশকতামূলক অগ্নিদুর্ঘটনা অসম্ভব কিছু নয়, তবে বাংলাদেশে তা শনাক্তের কোনো ব্যবস্থা নেই। এজন্য সব ঘটনাকেই দুর্ঘটনা হিসেবে ধরা হয়।” তিনি জানান, “যুক্তরাষ্ট্রে ৭৭ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটে, যুক্তরাজ্যে এই হার ৫৬ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এমন ঘটনা কম হলেও একেবারে নেই বলা যায় না।”

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান বলেন, “বিমানবন্দর একটি কেপিআই এলাকা। এমন স্থানে বড় অগ্নিকাণ্ড অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এটি শুধু দেশের নিরাপত্তা নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দ্রুত সবকিছু মেরামত করে বিমানবন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরিয়ে আনা জরুরি।” তিনি আরও বলেন, “আগেও বিমানবন্দরে আগুনের ঘটনা ঘটেছে, তখন সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে আজকের পরিস্থিতি হতো না।”

তিনি আরও অভিযোগ করেন, “সরকার প্রকৃত কারণ জানলেও তা প্রকাশ করে না। যদি তা প্রকাশ করা হয়, জনগণ সচেতন হবে এবং সরকারের ওপর চাপ তৈরি হবে পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য। এসব ঘটনায় পরিকল্পিত নাশকতার সন্দেহ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

অগ্নিনিরাপত্তা সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্বের বড় শহরগুলোতেও আগুন লাগে, কিন্তু তারা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশে এই সক্ষমতা এখনো সীমিত। নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার, সচিবালয়, গুলশানের ডিএনসিসি কাঁচাবাজার এবং ফুলবাড়িয়া মার্কেটের আগুনের ঘটনাগুলোয়ও একই সন্দেহ উঠেছিল—এসব কি সত্যিই দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে?

ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার বলেন, “সাম্প্রতিক আগুনের ঘটনাগুলোতে পরিকল্পিত নাশকতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এখন শুষ্ক মৌসুম, ফলে দাহ্য পদার্থ সহজে জ্বলে ওঠে। এর কারণেই দুর্ঘটনা বেড়েছে।” তিনি আরও জানান, “বর্তমানে বিমানবন্দরের অগ্নিনিরাপত্তার দায়িত্ব ফায়ার সার্ভিসের নয়, এটি সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের অধীনে। ফলে আমরা রুটিন পরিদর্শন বা মনিটরিং করি না।”

সাম্প্রতিক এসব আগুনের ঘটনায় দেশজুড়ে আতঙ্ক ও গুজব ছড়িয়ে পড়লেও এখনও স্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি—এগুলো কি সত্যিই দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত অগ্নিসংযোগ?

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top